কালারবার্ড মুরগি পালন পদ্ধতি || কৌশল ও খামার ব্যবস্থাপনা।

কালারবার্ড মুরগি অনেকের কাছেই অপরিচিত একটা নাম। কিন্তু এই মুরগি পালন যেমন সহজ, তেমনই লাভজনক। আর এর স্বাদ অনেকেটা দেশী মুরগির মতো। তাই দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অনেক খামারি ভাইয়েরা কালারবার্ড মুরগি পালনের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। কিন্তু ইচ্ছে সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে তারা সাহস করতে পারছেন না।

আমাদের আজকের লেখাটি তাদের জন্য, যারা চান কালারবার্ড মুরগি পালন করতে, কিন্তু জানেন না কীভাবে শুরু করবেন। আশা করি বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি পড়ে আপনি কালারবার্ড মুরগির পালন পদ্ধতি, কৌশল ও খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব তথ্য জানতে পারবেন।

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি ২ টি পর্বে বিভক্ত। আমরা আজকের পর্বের মাধ্যমে উপর্যুক্ত ৭টি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

আশা করি (বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লিখিত) এই প্রবন্ধ থেকে সকল খামারি ভাইয়েরা বেশ উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ।

প্রিয় পাঠক, এই লেখাটির পড়ার আগে আপনাকে কিছু শব্দের সাথে পরিচিত হতে হবে। তাহলে পুরো লেখাটি বোঝতে সহজ হবে। যেমন-

  • হোবার : বাচ্চাদের তাপ দেয়ার জন্য গোল ঢাকনার মতো যে জিনিসটায় বাতি লাগানো থাকে, সেটিকেই হোবার বলে। এটি সাধারণত টিনের তৈরি এবং এটি উপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
  • লিটার: মুরগির থাকার জন্য খামারে ধানের যে তুষ বা কাঠের গুঁড়া দেয়া হয় তাকে লিটার বলে।
  • চিকগার্ড/বর্ডার: সোজা বাংলা বেড়া। এটি সাধারণত প্লেনশিট (টিন) দিয়ে তৈরি। তবে কাগজের কার্টুন, মোটা কাপড় বা চট দিয়েও তৈরি করা যায়। এটি দিয়ে মুরগির বাচ্চাদের ঘেরাও করে রাখা হয়। একটি আদর্শ চিকগার্ডের উচ্চতা হচ্ছে ১৮ ইঞ্চি

কালারবার্ড মুরগি পরিচিতি:

ইংরেজি ‘কালার’ শব্দের অর্থ ‘রং’ এবং ‘বার্ড’ শব্দের অর্থ ‘পাখি’। শাব্দিক অর্থে ‘কালারবার্ড’ মানে ‘রঙিন পাখি’। মূলত কালারবার্ড হলো বিভিন্ন রঙের বা বর্ণের মুরগি । দেখতে দেশি মুরগির মতোই অনেকটা। তবে আদতে দেশি মুরগি না। চেক রিপাবলিকান জাতের মুরগির সংকরায়নের মাধ্যমে এই মুরগির জাত উৎপন্ন করা হয়েছে

প্রথম দেখায় অনেকেই এদের সোনালী মুরগি মনে করে ভুল করতে পারেন। কেননা সোনালী মুরগি আর কালারবার্ড দেখতে প্রায় একই রকম। তবে পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। যেমন অতি অল্প দিনেই কালারবার্ডের ওজন এক কেজি হয়ে যায়, যা সোনালী মুরগির ক্ষেত্রে হয় না। এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। সুতরাং বলা যায়, কালারবার্ড হলো এক ধরনের মুরগি, যা দেখতে অবিকল দেশি মুরগির মতোই (বিভিন্ন বর্ণের)। এদের বাণিজ্যিকভাবে পালন করা হয়।

কালারবার্ড মুরগির বৈশিষ্ট্য:

‘কালারবার্ড মুরগির বৈশিষ্ট্য’ লিখে অনলাইনে সার্চ দিলে ভূরিভূরি তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সব তথ্যই একেবারে সত্য নয়। কালারবার্ড পালন করে আমি যে-ই বৈশিষ্ট্যগুলো খোঁজে পেয়েঠি তা-ই নিচে উল্লেখ করা হলো।

  • প্রথমত, এই জাতের মুরগির বৈশিষ্ট্য আমাদের দেশী মুরগির মতই। ফলে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় পালনে অধিক উপযোগী।
  • দ্বিতীয়ত, এই মুরগির মৃত্যুরহার অনেক কম। বাচ্চা অবস্থায় ১-২%। তবে কোম্পানি ভেদে এই মান কম-বেশি হতে পারে।
  • তৃতীয়ত, খাবার খায় কম, ওজন আসে বেশি। যেমন, ৪৫ দিনে ২ কেজির থেকে কম খাবার খেয়ে গড়ে ১ কেজি বা তারচেয়ে বেশি ওজন আসে।

তাছাড়াও এই মুরগির –

  • রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
  • তুলনামূলক ওষুধ কম লাগে।
  • অন্যান্য মুরগির তুলনায় অধিক তাপ সহনশীল। ফলে হিটস্ট্রোক হয় না। গরমের দিনে ফ্যানও কম লাগে।
  • অল্প জায়গায় অধিক পালন করা যায়। আমরা ১১৪০ বর্গফুট জায়গায় ১৩০০ মুরগি অনায়াসেই পালন করতে পারি।
  • কালার বার্ডের মাংসের স্বাদ অনেকটাই দেশী মুরগির মতো।

কালারবার্ড পালনের উপযুক্ত সময়:

বছরের প্রায় সব সময়ই এই মুরগি পালন করা যায়। তবে শীতকালে বৃদ্ধি একটু কম হয়। তীব্র গরমে যদিও তেমন সমস্যা হয় না। তবে সবচে’ উপযুক্ত সময় হলো ফেব্রুআরির শুরুর দিক থেকে-জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

খামারে কালারবার্ড বাচ্চা তোলার আগে করণীয়:

এই ক্ষেত্রে অন্য মুরগি পালনের মতোই খামার প্রস্তুত করতে হয়। যেমন-

  1. মাকড়শার জালসহ আটকা পড়া সব ময়লা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়।
  2. খামার পাকা হলে জীবাণুনাশক দিয়ে ধুতে হয়।
  3. কাঁচা হলে, কাদা দিয়ে লেপে (প্রলেপ) দিতে হয়।
  4. তারপর জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হয়।
  5. তারপর চুন মিশ্রিত পানি ছিটাতে হয়।
  6. অতঃপর কয়েকদিন রেখে দিতে হয়।

বাচ্চা তোলার আগের দিন করণীয়:

বাচ্চা তোলার আগের দিন খামারের পর্দা নামিয়ে দিতে হবে। ব্রুডার প্রস্তুত করে কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। এতে করে ব্রুডারের তাপ সঠিক মাত্রায় উপনীত হয়। তখন বাচ্চা ব্রুডারে ছাড়ার সাথে সাথে আরামবোধ করে। তা না হলে হিট পেতে সময় লাগে। অবশ্য গরমের দিনে এতো আগে বাতি না জ্বালালেও সমস্যা হয় না। ২ কি ৩ ঘণ্টা আগে বাতি জ্বালিয়ে হলেও চলে।

কালারবার্ড মুরগির ব্রুডার ব্যবস্থাপনা:

এই জাতের মুরগি ব্রয়লারের মতো এতো দুর্বল নয়। তাই ব্রুডার ব্যবস্থাপনা নিয়ে এতো দুঃচিন্তার কারণ নেই। আপনি একটি হোবারের সাহায্যে ৩০০ থেকে ৩৫০ বাচ্চাকে অনায়াসেই হিট দিতে পারবেন। তবে শীতকালে এক হোবারের নিচে ৪০০ হলেও সমস্যা নেই। আমরা ৪৩০ পর্যন্ত রেখেছি। সমস্যা হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। তবে হাঁ, শীতকালে বাচ্চাদের ২০ দিনেরও বেশি তাপ দিতে হয়েছে। যদিও এবার শীতের প্রকোপ ছিলো বেশি। কিন্তু সব সময় তো এমন শীত থাকবে না। শীত কম থাকলে বাচ্চার হিটও কম লাগে। গ্রীষ্মকালে তো বাচ্চার হিট লাগে না বললেই চলে। এটি কালারবার্ড মুরগির পালনের একটা মজার দিক।

কালারবার্ড মুরগির লিটার ব্যবস্থপনা:

লিটার হিসেবে ধানের তুষ দিবেন। কাঠের গুঁড়াও দেয়া যায়। তবে তুষই ভালো এবং সহজলভ্য। লিটার কত ইঞ্চি দিবেন? আমরা গরমের দিনে ২ ইঞ্চি দিয়েছি। বেশি হলে সমস্যা নেই। খুব বেশি গরম পড়লে অবশ্য ১.৫ ইঞ্চি দিলেও চলবে। সমস্যা হয় না। তবে তুষের উপরের পেপার বিছিয়ে দিতেই হবে। এটি না করলে সমস্যা। কত দিন রাখবেন পেপার? ২ থেকে ৩ দিন। মাঝে মাঝে মুরগির বিষ্ঠায় ভিজে যাবে পেপার। তখন আবার নতুন পেপার বিছিয়ে দিবেন। এতে বাচ্চাগুলো ভালো থাকবে। ফলে ভালো থাকবে আপনার মনটাও।

কালারবার্ড মুরগীর বাচ্চা
কালারবার্ড মুরগীর বাচ্চা

বাচ্চা কিছুটা বড় হলে লিটার পা দিয়ে নেড়ে দিতে হবে। মুরগির বিষ্ঠা অনেক বেশি হয়ে গেলে চালনী দিয়ে চেলে দিতে হবে।

খামারে বাচ্চা তোলার পর করণীয়:

খামারে বাচ্চা তোলার পর ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত গ্লুকোজের পানি খাওয়াতে হয়। সাথে ভিটামিন সি দিলে ভালো। এতে বাচ্চা তৎক্ষণিক শক্তি পায়। ধকল দূর হয়। কেননা বাচ্চা পরিবহন করার ফলে তাদের উপর প্রচুর ধকল যায়। তা দূর করার জন্যই এই আপ্যায়ন!

বাজারে অবশ্য গ্লুকোজ এবং ভিটামিন-সি এর প্রি-মিক্স পাওয়া যায়। এটি খাওয়ানো যেতে পারে। আবার অনেককে দেখেছি পানিতে চিনি মিশিয়ে খাওয়াতে। সাথে লেবুর রস। দোকানে গ্লুকোজ পাওনা না গেলে বিকল্প হিসেবে এটি খাওয়ানো যেতে পারে। কী আর করার! ধকল দূর করতে হবে তো!

গ্লুকোজের পানির সাথে অল্প অল্প করে খাবারও দিতে হবে। প্রথম কয়েকদিন পেপারের উপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হয়। তারপর ট্রে মধ্যে দিতে হয়। খাবারে পাশাপাশি চলে সাদা পানি। অনেকে পানির সাথে লাইসোভিট মিশিয়ে দেন। এটি ভালো। এতে বাচ্চাগুলো ফুরফুরা থাকে। ঘণ্টা তিনেক পর পর বাচ্চাগুলো খেয়াল নিতে হয়, দেখতে হয় বাচ্চাগুলো সঠিক তাপ পাচ্ছে কি না।

কীভাবে বুঝবেন বাচ্চাগুলো সঠিক তাপ পাচ্ছে?

ব্রুডারে বাচ্চাদের তাপ দেয়ার দেয়ার সময় তিন ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-

  1. বাচ্চাগুলো হয়ত প্রয়োজনের চেয়ে কম তাপ পায়। কিংবা
  2. বাচ্চাগুলো হয়ত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তাপ পায়। অথবা
  3. বাচ্চাগুলো সঠিক তাপ পায়।

প্রয়োজনের চেয়ে কম কিংবা বেশি; উভয় তাপই বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। তাই বর্ডারে সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন হলো কীভাবে বোঝবো বাচ্চাগুলো সঠিক তাপ পাচ্ছে কিংবা পাচ্ছে না?

বিষয়টা একদমই সহজ। যখন দেখবেন-

  1. বাচ্চাগুলো জড়সড় হয়ে হোবারের নিচে বসে আছে, তখনই বোঝতে হবে, বাচ্চাগুলো পর্যাপ্ত তাপ পাচ্ছে না।
  2. বাচ্চাগুলো হোবার তথা বাতির নিচ থেকে সরে গিয়ে চিকগার্ড তথা বর্ডারের গা ঘেঁষে বসে থাকছে, তখন বুঝবেন হিট বেশি হচ্ছে।
  3. বাচ্চাগুলো খাবার খাচ্ছে, এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে, সুষমভাবে ছড়িয়ে আছে তখন বুঝবেন বাচ্চাগুলো সঠিক তাপই পাচ্ছে।

তাপ কম হলে কী করবেন?

  1. হোবারটি নিচে নামিয়ে দিবেন। তাতে যদি কাজ না হয়,
  2. বেশি পাওয়ারের বাতি লাগাবেন। তাতেও কাজ না হলে,
  3. বাতির পরিমাণ বাড়াবেন।

বাচ্চাগুলো বেশি তাপ পেলে কী করবেন?

একদম সহজ। এই ক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত বিপরীত কাজগুলো করবেন। যেমন

  1. হোবারটি আরেকটু উপরে উঠিয়ে দিবেন। তাতে কাজ না হলে,
  2. কম পাওয়ারের বাতি দিবেন। কিংবা,
  3. বাতির সংখ্যা কমিয়ে দিবেন।

মূলত, হোবারটি উপরে ওঠিয়ে দিলেই হয়। তারপর পর্যবেক্ষণ করে দেখবেন, বাচ্চাগুলো ব্রুডারে সুষমভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কি না। ছোটাছুটি করছে কি না।

আজকের পর্ব এইটুকুই। পববর্তী পর্বে আমরা বাকি বিষয়গুলো যেমন কালারবার্ড মুরগির রোগ-বালাই ও ওষুধপাতির ব্যবহারবিধি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আপনার দুআয় আমাদের ভুলবেন না। ফি-আমানিল্লাহ।

-মো: কাউছার হামিদ

Comments

6 responses to “কালারবার্ড মুরগি পালন পদ্ধতি || কৌশল ও খামার ব্যবস্থাপনা।”

  1. মোঃ শোয়াইব Avatar
    মোঃ শোয়াইব

    খুবই সুন্দর, চমৎকার, প্রাঞ্জল ভাষার সঠিক ও অসাধারণ লেখনি। পড়ে খুবই উপকৃত হলাম। লেখকের জন্য রইল আন্তরিক দোয়া মহান রবের আলীশান দরবারে।

  2.  Avatar
    Anonymous

    খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পৃয় ভাই

  3. নিহার Avatar
    নিহার

    ব্রুডিং চলাকালে এন্টিবায়োটিক দেয়া কী প্রোয়োজন?

  4. Tamim Avatar
    Tamim

    ভাই আপনার পোস্টটি পড়ে অনেক উপকারিত হলাম

  5. মোঃ আল হাসান Avatar
    মোঃ আল হাসান

    ভাইয়া আপনার সাথে যোগাযোগ করা যাবে

  6.  Avatar
    Anonymous

    আলহামদুলিল্লাহ উপকার পেলাম অনেক

Leave a Reply to মোঃ আল হাসান Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *