মুরগি পালনঃ লিটারের প্রকারভেদ ও ব্যবস্থাপনা

মুরগির-লিটার

পোল্ট্রি মুরগি পালনে লিটারের ভূমিকা খুবই গুরত্বপূর্ণ। আবদ্ধ অবস্থায় পোল্ট্রি পালনের ক্ষেত্রে লিটার পদ্ধতিতে মুরগির বিছানা হিসাবে লিটার ব্যবহার করা হয়। পোল্ট্রি লিটার অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা যায়। লিটার এক দিকে যেমন পোল্ট্রি উৎপাদনে সহায়তা করে ঠিক তেমনি সঠিকভাবে লিটারের যত্ন না নিলে এ থেকে বিভিন্ন রােগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই লিটার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়ােজন।

লিটার কি?

পশুপাখির বিছানাকেই ইংরেজিতে লিটার (Liter) বলে অর্থাৎ লিটার বলতে পোল্ট্রির ঘরের শয্যা হিসেবে ব্যবহৃত নানাবিধ বস্তুকেই বােঝায়। এক কথায় বাসস্থান আরামদায়ক করার জন্য মুরগির ঘরে যে বিছানা ব্যবহার করা হয় তাকে লিটার বলে।

যে সকল বস্তু লিটার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ঃ

ব্যবহৃত উপকরণের ভিত্তিতে লিটারের শ্রেণিবিন্যাস

মুরগির ঘরে লিটার বা বিছানা হিসেবে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যবহৃত দ্রব্যের নাম অনুযায়ী লিটারকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা

  • তুষের লিটার।
  • কাঠের গুঁড়ার লিটার
  • খড়ের ছােট টুকরার লিটার
  • আখের ছােবড়ার লিটার।
  • বালির লিটার।
  • নারিকেলের ছােবড়ার লিটার

মুরগির ঘরে লিটার স্থাপনের কৌশল :

  • লেয়ার ঘরে ওঠানাের ১ সপ্তাহ পূর্বে লিটার দ্রব্য স্থাপন করতে হবে।
  • লিটার বিছানাের পূর্বে ভালােভাবে ঘরের মেঝে শুকাতে হবে।
  • লিটারের দ্রব্য অবশ্যই নরম ও আরামদায়ক হবে।
  • লিটার ভেজা থাকলে রােদে শুকিয়ে ১০ % আর্দ্রতায় আনতে হবে। কারণ বেশি আর্দ্র হলে অ্যামােনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয়।
  • লিটার হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে খুব জোরে চাপ দিলে যদি জমাট না বাঁধে বা ঝরে না যায় তাহলে লিটারের অবস্থা ভালাে হিসাবে ধরে নিতে হবে।
  • শুকনা লিটার ব্যবহারের পূর্বে জীবাণুমুক্ত করে ঘরের মেঝেতে লিটার বিছিয়ে রাখতে হবে।
  • বিছানা বা লিটার যাতে বৃষ্টির ছাপে ভিজে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
মুরগির ঘরে লিটার স্থাপন
চিত্রঃ মুরগির ঘরে লিটার স্থাপন

মুরগির ঘরে লিটার ব্যবস্থাপনা:

  • লিটার যাতে মলমূত্রাদি বা খাবার পানির মাধ্যমে ভিজে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • লিটারের আর্দ্রতা বৃদ্ধির ফলে ছত্রাক যাতে জন্মাতে না পারে সেজন্য লিটার আচড়া ভালােভাবে ওলট পালট করে দিতে হবে।

দুই মাস পর লিটারের কার্যকারিতা শুরু হয়। এ সময়ের লিটারকে বিল্টআপ লিটার বলে। দুই মাস পর থেকে মুরগি নিজেরাই লিটার উল্টেপাল্টে নেয় বলে এই সময় মাসে একবার পরিচর্যা করতে হয়।

দুই মাস পর লিটারের মধ্যে প্রতি ১০০ মুরগির জন্য ২২৫ গ্রাম কাঁকর ছড়িয়ে দিতে হয়। আর্দ্রতা কম থাকলে পানি স্প্রে করতে হবে। লিটার ভিজে গেলে এর আর্দ্রতা কমানাের জন্য ঘরের মধ্যে বাতাসের প্রবাহ বাড়াতে হয়। এতে কাজ না হলে পুরােনাে লিটারে সাথে নতুন শুকনা লিটার মেশাতে হয় বা ভিজা লিটার ফেলে দিয়ে নতুন লিটার দিতে হবে।

লিটারের আর্দ্রতা দূর করার জন্য মাঝে মাঝে সুপার ফসফেট প্রতি ১ ঘন মিটারের জন্য ২২৫ গ্রাম হিসাবে মেশাতে হবে। লিটার কেক হলে ভেঙে দিতে হবে।

পুরু বিছানা যাতে জমাট না বাঁধে সে জন্য তাতে শুষ্ক চুন (১০ বর্গ মিটারে ৭-১০ কেজি চুন) সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে বিছানা নেড়ে মিশিয়ে দিতে হবে।

ব্যবহার শেষে লিটার পুনরায় ব্যবহার করতে চাইলে প্রতি ১ ঘন মিটার লিটারে ১ কেজি চুনের গুঁড়া মিশিয়ে ১ সপ্তাহ স্তুপ করে রাখলে পরিশুদ্ধ হয় এবং পরবর্তীতে এই লিটার ব্যবহার করা যায়।

মুরগির পালে যদি রােগ-ব্যাধি না থাকে তবে তাদের ব্যবহৃত লিটার পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে পুরােনাে লিটার ব্যবহার না করাই উত্তম। সংক্রামক রােগে আক্রান্ত পালের ব্যবহৃত লিটার পুড়িয়ে ফেলতে হয়।

ডিপ লিটার পদ্ধতি কি?

ডিম উৎপাদনের জন্য যেসকল মুরগি পালন করা হয়, এদের মেঝেতে ডিপ লিটার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ডিপ লিটার পদ্ধতিতে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি পুরু করে লিটার বিছাতে হবে। এবং নিয়মিত উল্টেপাল্টে দিতে হবে। সাধারণত বছর শেষে একবার লিটার পালটিয়ে দেয়া হয়।

যে সকল কাজে মুরগির লিটার ব্যবহার করা যায়ঃ

প্রতিটি বয়স্ক মুরগি দৈনিক গড়ে ১১৩-১২০ গ্রাম বিষ্ঠা ত্যাগ করে থাকে যার মধ্যে ২২-২৫ গ্রাম শুদ্ধ বস্তু থাকে। এই ২২-২৫ গ্রাম দৈনিক লিটারের সাথে সংযুক্ত হয়। এ ছাড়া লিটার পরিচর্যার সময় চুন ও সুপার ফসফেট লিটারের মধ্যে মেশানাে হয়। বিভিন্ন পােকা, ছত্রাক, রােগজীবাণু লিটারের মধ্যে জন্মে, যা লিটারের গাজন প্রক্রিয়ায় মারা যেয়ে লিটারের গুণাগুণ বৃদ্ধি করে।

১০০০ মুরগির খামারে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক বিষ্ঠা উৎপাদনের পরিমাণঃ

সময়মুরগি প্রতি বিষ্ঠা উৎপাদন (গ্রাম)১০০০ মুরগি থেকে মােট বিষ্ঠা উৎপাদন (টন)
দৈনিক ১১৩ ১১৩ কেজি-০.১১৩ টন
সাপ্তাহিক৭৯১০.৭৯১
মাসিক৩৩৯০৩.৩৯
বার্ষিক ৪০৬৮০ ৪০.৬৮

এই লিটার বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়, যথা

(ক) জৈব সার হিসাবেঃ ডিপ লিটার এ নাইট্রোজেনের পরিমাণ গােবর সার অপেক্ষা ১০ গুণ বেশি। ২৫টি মুরগি বছরে ১ টন জৈব সার তৈরি করতে পারে। ডিপ লিটার খােলা স্থানে না রেখে একটি একক চালা ঘর করে চারিদিকে বেড় দিয়ে এর মধ্যে জমা করতে হবে।

তবে লিটার পরিচয়ে কম্পােষ্ট সার তৈরি করলে গুণাগুণ আরও বৃদ্ধি পায়। মাটিতে গর্ত করে পচনশীল আবর্জনার স্তর তৈরি করে তার উপর লিটার দিয়ে ভরতে হবে। এর উপর কচুরিপানা, ঘাস, লতা পাতা দিয়ে ভরাট করে গর্তটি মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে। এ অবস্থায় দুই সপ্তাহ রেখে গর্ত থেকে তুলে সরাসরি জমিতে ব্যবহার করা যায় লিটার সরাসরি চারাগাছে।

লিটারের ব্যবহার
চিত্রঃ লিটারের ব্যবহার

(খ) মাছের খাদ্যে হিসেবেঃ ডিপ লিটার মাছের জন্য সুষম খাদ্য। এ খাদ্য দিলে মাছের জন্য অন্য কোনাে সম্পূরক বা পরিপূর্ণ খাবার এর প্রয়ােজন হয় না। এছাড়া খরচও কম হয়। লিটার পানিতে মাছের জন্য প্রয়ােজনীয় ফাইটোপ্লাংটন ও জুপ্লাংটন জাতীয় উদ্ভিদ উৎপাদনে সাহায্য করে যা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রতি হেক্টরে ৪৫.৫ কেজি লিটার প্রয়ােগ করা যেতে পারে। তবে লিটার বা বর্জ্য পদার্থ পুকুরে সরাসারি মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার না করে পচানাের পর ব্যবহার করতে হবে।

(ঘ) বায়ােগ্যাস হিসাবেঃ পারিবারিক ব্যবহারের জন্য প্রয়ােজনীয় বায়ােগ্যাস তৈরি করা যায় । লিটার থেকে বাতি জ্বালানাে ও রান্নার কাজে বায়ােগ্যাস ব্যবহৃত হয়।

(ঘ) হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবেঃ কিছু খাদ্য উপাদান মুরগির পরিপাকতন্ত্রের অপরিপাক অবস্থায় থাকে এবং মলের সাথে বেরিয়ে আসে। মুরগির পারিপাকতন্ত্রে বিপাকীয় কার্যক্রমে সংঘটনের ফলে অনেক উপজাত খাদ্য গবাদিপশুর খাদ্য উপযােগী মূল্যবান পুষ্টি উপাদানে রূপান্তরিত হয়।

হাঁস-মুরগির মলে দুর্গন্ধ, রােগজীবাণু ও ক্ষতিকর কিছু পদার্থ থাকে। এই সমস্ত প্রতিকারের জন্য এনরােবিক পদ্ধতিতে ফারমেনটেশন করতে হয়। গবদিপশুর দানাদার খাদ্যের পরিবর্তে শতকরা ৮০ ভাগ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত ব্যবহার করা যায় ।

(ঙ) পুনরায় ব্যবহারঃ লিটার-সামগ্রী পরিশুদ্ধ করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। প্রতি এক ঘনমিটার লিটারে এক কেজি চুনের গুঁড়া মিশিয়ে এক সপ্তাহ স্থূপ করে রাখলে লিটার পরিশুদ্ধ হয়। এই পরিশুদ্ধ লিটার পুনরায় লিটার হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

(চ) সার হিসেবে ব্যবহারঃ লিটার মৃত হাঁস-মুরগির সাথে কম্পােস্ট করে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। লিটারের সাথে মৃত হাঁস-মুরগি কম্পােষ্ট বিন পদ্ধতির মাধ্যমে কম্পােস্ট করে সার তৈরি করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়।

Comments

One response to “মুরগি পালনঃ লিটারের প্রকারভেদ ও ব্যবস্থাপনা”

  1. Humayun Ahmad Avatar

    ভাল উপায় এটা সমন্বিত চাষের বর্ননা

Leave a Reply to Humayun Ahmad Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *