মুরগির রোগ ও চিকিৎসা – রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস

coccidiosis

মুরগির অন্যতম একটি মারাত্বক রোগ হচ্ছে রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস। যেটি মূলত আইমেরিয়া নামক এক পরিজীবি প্রোটোজোয়ার ফলে সক্রমিত হয়। সাধারনত এটি বাচ্চা মুরগিকেই বেশী ক্ষতি করে। তবে যেকোন বয়সের মুরগিরই এটি হতে পারে।

এর ফলে মোরগ-মুরগিতে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি, খাদ্যের রূপান্তর হার হ্রাস করে এবং দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে ।আর্দ্র পরিবেশে রোগটি সহজে ছড়ায়। তাই সাধারণত বর্ষাকালে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

প্রোল্ট্রি প্রজাতির প্রায় সবগুলোই পাখিই এর জীবানু বহন করে থাকে।

রক্ত আমাশয়
ছবিঃ উইকিপিডিয়া

ককসিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় রোগ কি

রক্ত আমাশয় বা ককসিডিউস মুরগির অন্ত্রনালীর একটি মারাত্বক রোগ যা আইমেরিয়া নামক প্রোটোজোয়ার ফলে হয়ে থাকে। আইমেরিয়ার অনেকগুলি প্রজাতি থাকলেও সাধারনত কয়েকটি প্রজাতি ককসিডিউস রোগের জন্য দায়ী। যেমন,

  • আইমেরিয়া টেনেলা (E. tenella)
  • আইমেরিয়া ব্রুনেটি (E. brunetti)
  • আইমেরিয়া ম্যাক্সিমা (E. maxima)
  • আইমেরিয়া নেক্রোটিক্স (E. necatrix)
  • আইমেরিয়া এসারভুলিনা (E. acervulina)
  • আইমেরিয়া মেভেটি, (E. meveti)
  • আইমেরিয়া মিটিস(E. mitis)
  • আইমেরিয়া হেগেনি, (E. Hegene)
  • আইমেরিয়া প্রিকক্স (E. praecox)।
রক্ত আমাশয়
ছবি

আইমেরিয়া প্রজাতির মধ্যে আইমেরিয়া টেনেলা ও আইমেরিয়া নেক্রোটিক্স মুরগির বেশি ক্ষতি করে থাকে।

ককসিডিওসিস রোগের কারন

প্রধানত মুরগির বিষ্ঠার মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। দেখা গেছে, এক গ্রাম বিষ্ঠায় প্রায় ৭০ হাজার কক্সিডিয়ার জিবানু থাকতে পারে।

আইমেরিয়া জীবাণুর ওসিস্ট (sporulated oocyst) খাওয়ার ফলে মুরগি ককসিডিওসিসে আক্রান্ত হয়। ওসিস্ট খেয়ে আক্রান্ত হলেও ওসিস্ট কিন্তু রোগ সৃষ্টিকারী মূল জীবাণু নয়, বাহক মাত্র। রোগ সৃষ্টি করে স্পোরোজোয়েট যা স্পোরোসিস্ট নামক এক প্রকার থলের ভেতরে থাকে এবং এ দুটোই বাইরে থেকে শক্ত দুটি দেয়াল দিয়ে আবৃত থাকে।

একটি আইমেরিয়া ওসিস্টের ভেতরে চারটি স্পোরোসিস্ট থাকে। যার প্রতিটির মধ্যে আবার দুটো করে স্পোরোজোয়েট থাকে। অর্থাৎ একটি ওসিস্ট খেয়ে একটি মুরগি আটটি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু পেয়ে থাকে।

সাধারণত দুই মাস বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা ককসিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়। তবে এর মধ্যে আক্রান্ত না হলেও পরবর্তী যেকোনো সময় ককসিডিয়া জীবাণুর সংস্পর্শে এলে এবং তা খেয়ে ফেললে কক্সিডিয়া বা রক্ত আমাশয় হতে পারে।

মুরগির পরিপাকতন্ত্র
মুরগির পরিপাকতন্ত্র

আইমেরিয়ার যে প্রজাতি দ্বারা মুরগি একবার আক্রান্ত হয় সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু অন্য প্রজাতির প্রতি সংবেদনশীল থাকে। ফলে পরবর্তিতে অন্য প্রজাতির আইমেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হলে মুরগির রক্ত আমাশয় বা কক্সিডিয়া হতে পারে।

প্রতিটি প্রজাতির আইমেরিয়া মোরগ-মুরগির পরিপাকতন্ত্রের নির্দিষ্ট স্থানে আক্রমণ করে। যেমন টেনেলা সিকামে, ব্রুনেটি বৃহদন্তে (Large intestine) এবং এসারভুলিনা ক্ষুদ্রান্ত (small intestine) বা নাড়িতে আক্রমণ করে। টেনেলা কখনই ডিওডেনামকে এবং এসারভুলিনা সিকামকে আক্রমণ করে না।

রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস রোগের লক্ষনসমূহ

আভ্যন্তরীন লক্ষনসমূহঃ

সিকাল কক্সিডিউসিস হলে সিকামে তাজা রক্ত পাওয়া যাবে। এছাড়া ইন্টেস্টাইনাল কক্সিডিউসিস হলে ইন্টেস্টাইনে ক্ষত পাওয়া যায়। নিচে এর বর্ননা দেয়া হলো।

ইন্টেসটাইনাল ককসিডিওসিস

ইন্টেস্টাইনাল কক্সিডিউসিস এর জন্য দায়ি হচ্ছে আইমেরিয়া এসারভুলিনা (E. acervulina) ও আইমেরিয়া ম্যাক্সিমা (E. maxima) প্রোটোজোয়া।

এদের দ্বারা আক্রান্ত হলে মুরগির অন্ত্রের মধ্যে রক্ত আমাশয় সীমাবদ্ধ থাকে।আইমেরিয়া ম্যাক্সিমা (E. maxima) মুরগীর ডিউডেনামের লুপ থেকে কুসুম থলি পর্যন্ত এরা থাকে।

ইন্টেস্টাইনে রক্ত বিন্দু দেখে এদের কে শনাক্ত করা যায়। এরা সাধারনত মিডল ইন্টেস্টাইনে থাকে।

ককসিডিওসিস

আইমেরিয়া এসারভুলিনা (E. acervulina) পুরা ডিউডেনামেই থাকে। মুরগীর ইন্টেস্টিনাল ককসিডিওসিস এর ফলে খামারে অনেক ক্ষতি হয়।

সিকাল ককসিডিওসিস

আইমেরিয়া টেনেলা (E. tenella) সিকাল কক্সিডিওসিসএর জন্য দায়ী। এর ফলে মুরগীর ব্যাপক রক্তশুন্যতা দেখা দেয়।

লিটার বা মেঝেতে বিষ্ঠার সাথে টাটকা রক্ত পড়তে দেখা যায়। অসুস্থ মুরগীর পোস্টমার্টেমে সিকামে রক্ত পাওয়া যায়।

বাহ্যিক লক্ষনসমূহঃ

মুরগির রক্ত আমাশয় হলে পালক উসখো, খুসকো থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাবে।ওজন বৃদ্ধি হ্রাস পায়।খাদ্য ও পানি গ্রহন কমিয়ে দিবে। অনেক সময় ঠোকরা ঠুকরি করে।

তীব্র রক্ত আমাশয় হলে ফার্মের লিটারে তাজা রক্ত পাওয়া যায়।

চিকিৎসাঃ  

কক্সিডিওসিস প্রতিরোধে বা চিকিৎসায় অনেক ধরনের মেডিসিন বাজারে বিদ্যমান।

রোগের তীব্রতা বিবেচনাপুর্বক এম্প্রোলিয়াম হাইড্রোক্লোরাইড, টল্ট্রাজুরিল, সালফার ড্রাগস, ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।

তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ান এর সাথে পরামর্শ পূর্বক চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।

প্রতিরোধের উপায়ঃ

  • বর্ষাকালে ও আর্দ্র পরিবেশে এর জীবানু দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে। তাই সর্বদা লিটার শুষ্ক রাখতে প্রয়োজন।
  • লিটার নিয়মিত ওলট পালট করা এবং ভিজা লিটার সরিয়ে ফেলা জরুরী।
  • খাদ্য ও পানির পাত্র সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে।
  • যেহেতু রোগটি আক্রান্ত মুরগির বিষ্ঠার মধ্যমে ছড়ায়, তাই খাদ্য ও পানির পাত্র মুরগির পিঠ বরাবর রাখা প্রয়োজন। যেন খাদ্য-পানির পাত্র মুরগির বিষ্ঠা থেকে মুক্ত থাকে।
  • অধিক ঘনত্বে মুরগি পালন ও বিভিন্ন বয়েসের মুরগি একত্রে পালন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • পুষ্টির ঘাটতি হলে রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। এজন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
  • খাদ্যে কক্সিডিওস্ট্যাট ব্যবহার করে রক্ত আমাশয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  • সর্বোপরি জৈব নিরাপত্তা রোগটি থেকে মুক্ত রাখতে পারে।

বয়স্ক মুরগিতে কক্সিডিয়া তেমন প্রাভাব বিস্তার না করতে পারলেও বাড়ন্ত মুরগীতে এর ব্যাপক ক্ষতিকারক প্রভাব রয়েছে। আমাদের দেশে এই ক্ষতির পরিমান বছরে কয়েকশত কোটি টাকা।

রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস থেকে আপনার খামার মুক্ত রাখতে এই লেখাটি সাহায্য করবে বলে আশা রাখি।

আরো পড়তে পারেনঃ

মুরগির রোগ ও চিকিৎসা – গামবোরো

মুরগির রোগ ও চিকিৎসা – রানীক্ষেত

দেশি মুরগির ভ্যাকসিন সিডিউল

সোনালি মুরগির ভ্যাকসিন সিডিউল

ব্রয়লার মুরগির ভ্যাকসিন সিডিউল

হাঁসের ভ্যাকসিন সিডিউল

Comments

3 responses to “মুরগির রোগ ও চিকিৎসা – রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস”

  1. Sadik Avatar

    পোল্ট্রি বিষয়ে কিছু শিখতে চাই।

  2. মুসলিম শাইখ Avatar
    মুসলিম শাইখ

    সোনালী মুরগীর আরও কিছু কঠিন রোগ ও তার চিকিৎসা ও ঔষধ বললেন।

    1. Poultry Gaints Avatar

      আপনি আমাদের এই লেখাগুলি পড়তে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *