ভাইরাস জনিত রোগের মধ্যে মুরগির রানীক্ষেত রোগটি সবচেয়ে মারাত্বক। এই রোগের ফলে শতভাগ মৃত্যু হতে পারে। যদিও পৃথিবির কিছু দেশ এই রোগটি থেকে মুক্ত তারপরেও কমবেশি সারা বিশ্বেই এই রোগ দেখা যায়। বিষেশত আমাদের উপমহাদেশ সহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে এই রোগটি একটি মহামারি হিসেবে বিবেচিত। মুরগির রোগ ও চিকিৎসা- গামবোরো লেখাটি পড়তে পারেন।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে রানিক্ষেত রোগ সর্বপ্রথম ১৯২৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে শনাক্ত হয়। এরপর যুক্তরাজ্যের নিক্যাসল শহরে এটি ১৯২৭ সালে দেখা যায়। এখান থেকেই এই রোগটির নামকরন ‘নিউক্যাসল ডিজিজ’ করা হয়। ভারতের রানীক্ষেত নামক স্থানে এটি সর্বপ্রথম ১৯২৮ সালে শনাক্ত হয়।
মুরগির রানীক্ষেত রোগ কি
নিউক্যাসল রোগটি মোরগ-মুরগি ও অন্যান্য পোল্ট্রির ভাইরাসজনিত একটি রোগ। যা মূলত, ‘নিউক্যাসল ডিজিজ ভাইরাস‘ (এনডিভি) দ্বারা সংক্রমণ। এটি প্রাথমিকভাবে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের রোগ হিসাবে দেখা দেয়। তবে ঝিমানো, দুর্বলতা বা স্নায়বিক প্রকাশ এবং ডায়রিয়ার মত লক্ষনসমূহ দেখা যেতে পারে।
নিউক্যাসল ডিজিজ ভাইরাস বা এনডিভি ‘প্যারামিক্সোভাইরাস’ পরিবারের মধ্যে ‘অ্যাভুলাভাইরাস‘ বংশের অন্তর্ভুক্ত। এনডিভির বিভিন্ন স্ট্রেইন রয়েছে। অতিতীব্র ভেলোজেনিক, মাঝারী মেসোজেনিক ও মৃদু লেন্টোজেনিক।
ভ্যাকসিন এর জন্য এদেরকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। সাধারনভাবে ‘ভেলজেনিক’ ও ‘মেসোজেনিক’ স্ট্রেইন তীব্র এবং ‘লেন্টোজেনিক’ স্ট্রেইনকে মৃদু বিবেচনা করা হয়।
ভাইরাসের সবচেয়ে মারাত্মক স্ট্রেইনটিকে ‘ভিসারোট্রপিক ভেলোজেনিক নিউক্যাসল ডিজিজ’ বা ‘ভিভিএনডি’ বলা হয়, যাকে প্রায়শই ‘এক্সোটিক নিউক্যাসল ডিজিজ’ বলা হয়।
মুরগির রানীক্ষেত রোগের কারন
মুরগির ‘রাণীক্ষেত’ বা ‘নিউক্যাসল ডিজিজ‘ একটি তীব্র সংক্রামক রোগ। সাধারণত সংক্রামিত বা আক্রান্ত পাখি থেকেই এটি ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত ২ থেকে ৬ দিনের মধ্যেই সমস্ত ফ্লকে এটি বিস্তার লাভ করে।
সংক্রমণের অন্যান্য উৎস হলো, দূষিত সরঞ্জাম, মৃত মুরগি, কাদ্য, পানি এবং পোশাক। বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি সহজেই একটি শেড বা ফার্ম থেকে অন্য শেডে নিয়ে যেতে পারে।
নিউক্যাসল ডিজিজ মুরগি ছাড়াও অন্যানয় পাখি যেমন, কবুতর, কোয়েল, টার্কি ও হাঁসের মধ্যেও হতে পারে। তবে এটি টার্কি, হাঁস বা কোয়েলের উপর তেমন প্রাভাব রাখেনা। এনডি ভাইরাস পাখিদের মতো মানুষকে প্রভাবিত করে না তবে এটি মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে।
রানীক্ষেত রোগের লক্ষনসমূহ
নিউক্যাসল ডিজিজ একটি প্যারামিক্সোভাইরাস দ্বারা ঘটে যা মৃদু থেকে অত্যন্ত তীব্র প্যাথোজেনিকের মধ্যে লক্ষনসমূহ পরিবর্তিত হতে পারে। যদি লেন্টোজেনিক স্ট্রেইনের ফলে রানীক্ষেত হয় তবে, এর লক্ষন শুধুমাত্র শ্বাসনালিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এবং মাইকোপ্লাজমা দ্বারা সেকেন্ডারী ইনফেকশন হয়ে এর লক্ষণ দেখা দিবে।
যদি মেসোজেনিক বা ভেলোজেনিক স্ট্রেইনের ফলে মুরগির রানীক্ষেত রোগ হয়, তাহলে এটির লক্ষন পাখির বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে। যেমন শ্বাসনালী,পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি।
“সাধারণত রানীক্ষেত রোগের লক্ষনসমূহ ৫ টি প্যাথোটাইপে বিভক্ত।”
১. ভিসেরুট্রপিক ভেলোজেনিক (Viscerotropic Velogenic) ঃ অতিতীব্র
মুরগি হঠাত বসে পড়ে। মুরগির নাড়ি/ ক্ষুদ্রান্ত আক্রান্ত হয়ে রক্তক্ষরণ হয়। সবুজ রং এর পায়খানা হয়। সিকামে রক্ত পাওয়া যায়। প্রভেন্টিকোলাসে রক্তের ফোটা দেখা যায়। ধমনী বা প্লীহাতে সাদা স্পট দেখা যায়।
খুব দ্রুত এক মুরগি থেকে অন্য মুরগি সংক্রমিত হয়। মুরগি খাদ্য গ্রুহন কমিয়ে দেয়। বিষ্ঠায় রক্ত দেখা যায়।
সাধারণত, ৩-৫ দিনের মধ্যে বেশি মারা যায়। মৃত্যহার ১০০% পর্যন্ত হতে পারে।
২.নিউরুট্রপিক ভেলোজেনিক (Neurotropic Velogenic) ঃ তীব্র
মুরগির স্নায়ুতন্ত্র এবং শ্বাসনালী আক্রান্ত হয়। শ্বাসকষ্ট ও ট্রাকিয়ায় রক্ত ক্ষরণ হয়। পা, ঘাড় ও গলা প্যারালাইসিস হয়। পাতলা ও খোসা ছড়া ডিম পাড়ে। ডিম উৎপাদন কমে যায়। মৃত্য হার ১০০% পর্যন্ত হতে পারে।
সাধারনত এটি ডিমের মুরগির রানীক্ষেত হলে বা রাণিক্ষেতের টাইটার ফল করলে বেশি দেখা যায়।
৩.নিউরোট্রপিক মেসোজেনিক (Neurotropic Mesogenic) ঃ মাঝারী-তীব্র
প্রধানত শ্বাসনালী আক্রান্ত হয়। মুখ ফুলে যায়। শ্বাসকষ্ট হয় ও গড় গড় শব্দ করে। ট্রাকিয়ায় রক্ত দেখা যায়। মাঝে মাঝে স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয়ে প্যরালাইসিস হতে পারে। সাধারণত এটি ছোট মুরগিতে বেশি দেখা যায়। মৃত্যহার বেশি।
বড় মুরগি আক্রান্ত হলে, খাবার কম খায় ও ডিম উৎপাদন কমে যায়।
৪. শ্বাসনালীয় লেন্টোজেনিক (Tracheitis Lentogenic) ঃ মৃদু
শ্বাসনালীর ইনফেকশন হয়। গড় গড় শব্দ করে এবং অনেক দিন ধরে থাকে।
চোখ মুখ ফুলে থাকে। এন্টিবায়োটিকে ভাল কাজ করেনা। মৃত্যহার কম হয়। দীর্ঘ সময় ধরে মুরগির ক্ষতি করে থাকে।
৫. এন্টেরোট্রপিক এপ্যাথোজেনিক (Enterotropic Epathogenic) ঃ অতি-মৃদু
পাকস্থলীতে ইনফেকশন ও ক্ষুদ্রান্তে ক্ষত দেখা যায় যা পরবর্তিতে ভেলোজেনিক রানিক্ষেতে রুপ নেয়। চুনের মত পাতলা পায়খানা করে।
তবে অনেক সময় সাদা, সবুজ ও হলুদ বর্ণের মিশ্রণ বা শুধু সবুজ বা হলুদ পায়খানা হতে পারে। মলদ্বারে পায়খানা লেগে থাকে। খাদ্য গ্রহন ও ডিম উৎপাদন কমে যেতে পারে। মৃত্যহার থাকেনা।
মুরগির রানীক্ষেত রোগের চিকিৎসা
মুরগির রানীক্ষেত রোগ বা নিউক্যাসল ডিজিস এরজন্য এখনো কোন চিকিৎসা নেই। তাই প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন দিতে হবে। তবে আক্রান্ত হয়ে পড়লে, ‘সেকেন্ডারি ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন’ বা গৌণ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এন্টিবায়োটিক দেয়া যেতে পারে। সাথে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার দেয়া যেতে পারে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ভিটামিন এ দেয়ার ফলে আক্রান্ত মুরগির মৃত্যুর হার ৩% পর্যন্ত কমিয়ে দেয় এবং দেহে এনডিভি ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবকে হ্রাস করে। আক্রান্তের হার ১০% এর কম হলে রানিক্ষেতের টিকা দেয়া যায়।
এজমা