বহু প্রাচীনকাল অর্থাৎ (প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে মােরগ-মুরগিকে পােষ মানিয়ে গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালনের ইতিহাস জানা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জঙ্গলের বন্য মুরগি থেকে আধুনিক গৃহপালিত মােরগ-মুরগির উৎপত্তি হয়েছে বলে জানা যায়। ইউরােপীয় বণিকেরা এশিয়া থেকে মুরগি সংগ্রহ করে সেগুলােকে নিজের দেশে নিয়ে যেত। ধারণা করা হয় যে, নিম্নলিখিত চারটি বন্য প্রজাতির থেকে আধুনিক মােরগ-মুরগির উৎপত্তি হয়েছে।
নাম | ইংরেজি নাম | বৈজ্ঞানিক নাম |
রেড জঙ্গল ফাউল | Red jungle fowl | Gallus gallus |
সিলােন জঙ্গল ফাউল | Ceylon Jungle fowl | Gallus lafayetti |
গ্রে জঙ্গল ফাউল | Grey Jungle fowl | Gallus Sonnerratti |
জাভা জঙ্গল ফাউল | Java Jungle fowl | Gallus varius |
উল্লিখিত Gallus gallus প্রজাতিটি মােরগ-মুরগির প্রধান পূর্বপুরুষ বলে ধরা হয়। তবে চারটি প্রজাতিই অত্যন্ত সম্পর্কযুক্ত এবং এগুলাে ইন্টারব্রিউ হিসেবে পরিচিত।
জাতের সংজ্ঞা শ্রেণি (Class) : যে সমস্ত মােরগ-মুরগির জাত কোনাে এক বিশেষ জায়গা থেকে উদ্ভূত বা উৎপন্ন হয়েছে, সে সমস্ত জাতকে সমষ্টিগতভাবে একটি শ্রেণি বলা হয়।
যেমন : এশিয়াটিক শ্রেণি, আমেরিকান শ্রেণি ইত্যাদি।
জাত (Breed): একই শ্রেণির অন্তর্গত একটি জাতের মােরগ-মুরগির নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য থাকবে, যেমন- দেহের আকার, আকৃতি, চামড়ার রং, আঙ্গুলের সংখ্যা, পায়ের নালা পালকবিহীন না পালকাবৃত, ডিমের রং ইত্যাদি। এই বৈশিষ্ট্যগুলাে পরবর্তী বংশধরে সমভাবে প্রকাশ পাবে।
যেমন – লেগহর্ন, ব্লাক অস্ট্রালপ ইত্যাদি জাত।
উপজাত (Variety): পালকের রং এবং মাথার খুঁটির ধরনের উপর ভিত্তি করে একটি জাতের উপবিভাগকে উপজাত বলা হয়। | যেমন- লেগহর্ন জাতের মধ্যে আবার একক খুঁটি বিশিষ্ট হােয়াইট লেগহর্ন, গােলাপ সদৃশ ঝুঁটি বিশিষ্ট হােয়াইট লেগহর্ন ইত্যাদি উপজাত রয়েছে।
স্ট্রেইন (Strain): কোনাে একক প্রজননকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কমপক্ষে ৫ বংশ পরম্পরায় প্রজননের মাধ্যমে সৃষ্ট একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মুরগির উপজাতকে স্ট্রেইন বলে। যেমন: স্টার ক্রস, স্টার ব্রো। এটা বিশেষ উদ্দেশ্যে বংশ পরম্পরায় ইনব্রিডিং-এর মাধ্যমে তৈরি হয়।
উপযােগিতার উপর ভিত্তি করে মুরগির শ্রেণি বিভাগ :
উপযােগিতার উপর ভিত্তি করে মুরগির জাতকে বিভিন্নভাবে শ্রেণি বিন্যাস করা যায়। যেমন
১. উৎপাদন অনুসারে :
উৎপাদন অনুসারে মুরগির জাতকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
(ক) ডিম উৎপাদনকারী জাত : এই শ্রেণির মুরগি সাধারণত আকারে ছােট হয়। এরা খুব তাড়াতাড়ি অর্থাৎ ২০ সপ্তাহ বয়সের মধ্যেই ডিম পাড়া শুরু করে। এরা ডিম উৎপাদন করে বেশি কিন্তু ডিমের আকার তুলনামূলকভাবে ছােট হয়। ডিম উৎপাদনের পর কুঁচে হয় না। যেমন- লেগহর্ন, মিনার্কা, ফাউমি, এনকোনা।
(খ) মাংস উৎপাদনকারী জাত : এই শ্রেণির মুরগি আকারে বড় হয় এবং ওজন বেশি হয়। এরা চলাফেরায় ধীরগতিসম্পন্ন এবং শান্ত প্রকৃতির হয়। যেমন- ব্রাহ্মা, কোচিন, ল্যাংশেন, আসিল এবং মালয়ী।
(গ) ডিম ও মাংস উৎপাদনকারী জাত : এই শ্রেণির মুরগি ডিম ও মাংস উৎপাদনে ভালাে। এদের ওজন | মাঝারি ধরনের এবং ডিমের ওজন বেশি। যেমন- রােড আইল্যান্ড রেড, কর্নিশ, জার্সি জায়ান্ট, অস্ট্রালপ নিউহ্যাম্পশায়ার, প্রাইমাউথ রক বা ক্রয়লার ইত্যাদি।
(ঘ) শােভা দর্শনকারী শ্রেণি : এই শ্রেণির মুরগি শােভা বর্ধন – খেলাধুলা এবং মােরগ লড়াই দেওয়ার জন্য পালন করা হয়। যেমন- ইয়ােকোহামা, জাপানি বেন্টাম, আসিল ইত্যাদি।
২. উৎপত্তি অনুসারে মুরগির জাতের শ্রেণি বিন্যাস :
উৎপত্তি স্থান অনুসারে মুরগির শ্রেণি চারটি।
(ক) আমেরিকান শ্রেণি (American Class): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আশপাশের দেশসমূহে এই শ্রেণির মুরগির উৎপত্তি হয়েছে। যেমন- নিউহ্যাম্পশায়ার, ল্যামােনাস, প্লাইমাউথ রক, আর-আই-আর, জার্সি জায়ান্ট।
আমেরিকান শ্রেণির অধীনে মােট ১৩টি জাত রয়েছে। এ জাতগুলাে যুক্তরাষ্ট্র উৎপন্ন হয়েছিল বলে এদেরকে আমেরিকান শ্রেণির জাত বলা হয়ে থাকে। সাধারণত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আনা ছােট জাতের কর্মঠ মুরগির সাথে এশিয়া থেকে আমদানি করা বড় আকারের মােরগের সংকর প্রজনন করে আমেরিকান শ্রেণির মুরগি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এখানে এদের বৈশিষ্ট্যগুলাে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারন বৈশিষ্ট্যসমূহ:
এদের পায়ের নালা পালকবিহীন। কানের লতি লাল রঙের। গায়ের চামড়া হলুদ ও ডিমের রং বাদামি। সাধারনত ডুয়াল পারপাজ বা ডিম মাংস উভয়ের জন্যই এরা উপযোগি।
(খ) ইংলিশ শ্রেণি (English Class): এই শ্রেণির মুরগিসমূহের উৎপত্তি হয়েছে মূলত ইংল্যান্ডে। তবে অস্ট্রাপ মুরগির উৎপত্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়াতে। এদের মাংস খুব সুস্বাদু। যেমন- সাসেক্স, অরপিংটন, ডর্কিং, কর্নিশ, রেডক্যাপ, হাউড্যান্স ইত্যাদি।
সাধারন বৈশিষ্ট্যসমূহ:
এদের পায়ের নালা পালকবিহীন। গায়ের চামড়া সাদা ও কানের লতি লাল রঙের। ডিমের রং লাল ও বাদামি। সাধারনত ডিম মাংস উভয়ের জন্যই এরা উপযোগি।
(গ) এশিয়াটিক শ্রেণি (Asiatic Class) : এই শ্রেণির মুরগিসমূহ উৎপত্তি লাভ করেছে এশিয়া মহাদেশে। যেমন- অসিল, মালয়ী, ল্যাংশেন, কোচিন, ইয়ােকোহামা, ব্রাহ্মা, বেন্টাম।
এশিয়াটিক শ্রেণির মুরগি সাধারণত আকারে বড় এবং মাংস উৎপাদনের জন্য ভালো। তবে এ শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত সমুহ বাণিজ্যিকভিত্তিতে ডিম বা মাসে উৎপাদনে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। ল্যাংশ্যান ও এর উপজাতের মুরগি ছাড়া বাকিদের চামড়ার রঙ হলুদ। এখালে এদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল।
সাধারন বৈশিষ্ট্যসমূহ:
সাধারণত এদের পায়ের নালায় পালক থাকে। কানের লতির লাল রঙের। ডিমের কালার বাদামি। গায়ের চামড়া হলুদ হয়ে থাকে । এ্ররা অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে। ডিম উৎপাদনের হার কম। তাই সাধারনত এদেরকে মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়।
(ঘ) ভূমধ্যসাগরীয় শ্রেণি (Mediterranean Class) : ভূমধ্যসাগরীয় শ্রেণির জাতগুলাের উৎপত্তিস্থল ইটালি ও আশপাশের অঞ্চলে। ভূমধ্যসাগরের আশপাশের দেশ যেমন- ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, মিসর ইত্যাদি দেশে এই শ্রেণির মুরগি উৎপত্তি লাভ করেছে। যেমন- লেগহর্ন, ফাউমি, মিনার্কা, এনকোনা, বাটারক্যাপ, স্প্যানিশ, ব্ল-আন্দালুসিয়ান।
এদের মধ্যে লেগহর্ণ সবচেয়ে জনপ্রিয়। ডিম উৎপাদনের জন্য এরা বিখ্যাত। লেগহর্ন জাত মুরগির জাত উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।মিনকা ছাড়া অন্য সবগুলাে জাত ছােট আকারের।
সাধারন বৈশিষ্ট্যসমূহ:
এদের পায়ের নালা পালকবিহীন। পালক আঁটসাঁট ও দেহের সাথে সুবিন্যস্ত। এরা আকারে ছােট। কুঁচে হওয়ার অভ্যাস একেবারেই নেই। অপেক্ষাকৃত কম বয়সে ডিম দেয়া শুরু করে। ডিম উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এদের গায়ের চামড়ার রঙ সাদা অথবা হলুদ। কানের লতি সাদা রঙের। ডিমের খােসার রঙ সাদা।
উৎপত্তিস্থান অনুযায়ী মুরগির শ্রেণিবিন্যাসঃ
আমেরিকান (জাত) | ইংলিশ (জাত) | ভূমধ্যসাগরীয় (জাত) | এশিয়াটিক (জাত) |
রোড আইল্যান্ড রেড নিউ হ্যাম্পশায়ার প্লাইমাউথ রক ওয়েইন্ডােট জ্যভিস জার্সি জায়ান্টস ল্যামােন্যাস ডােমনিকুইস | সাসেক্স অস্ট্রালর্প করনিস্ রেড ক্যাপস ডরকিংস | লেগহর্ন মিনরকাস এনকোনাস স্প্যানিশ আন্দালুসিয়ান বাটার কাপস ফাওমি | ব্রাহমা কোচিন ল্যাংশ্যান আসিল ফোনিক্স |
৩. ওজন অনুসারে শ্রেণিবিন্যাস:
ওজন অনুযায়ী মুরগির শ্রেণি তিনটি।
(ক) হালকা জাত: এই শ্রেণির মুরগির গড় ওজন ১.৮-২.৪ কেজি। যেমন-লেগহর্ন, ফাউমি, মিনার্কা।
(খ) মাঝারি জাত: এই শ্রেণির মুরগির গড় ওজন ২.৫-৩.০ কেজি। যেমন-ডর্কিং, নিউহ্যাম্পশায়ার, রােড। আইল্যান্ড রেড, প্লাইমাউথ রক।
(গ) ভারী জাত: এই শ্রেণির মুরগির গড় ওজন ৩ কেজির বেশি। যেমন- আসিল, জার্সি জায়ন্ট, কর্নিশ।
৪. কুঁচে হওয়ার প্রবণতা অনুযায়ী মুরগির জাত বিন্যাস :
কুঁচে হওয়ার প্রবণতা অনুযায়ী মুরগিরকে দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
(ক) সিটার (Sitter): এই শ্রেণির মুরগি ডিম পাড়ার পর ডিমে তা দেয়ার লক্ষণ প্রকাশ করে। বাচ্চার। ভালাে যত্ন নেয়। যেমন- ব্রাহ্মা, আসিল, কোচিন, ল্যাংশেন ।
(খ) নন সিটার (Non sitter): এই শ্রেণির মুরগি ডিম পাড়ার পর ডিমে তা দেয়ার লক্ষণ প্রকাশ করে না বা কুঁচে হয় না। এরা বাচ্চার যত্ন নেয় না। যেমন- লেগহর্ন, মিনার্কা, এনকোনা।
পরিশেষেঃ
মুরগির সাধারন বৈশিষ্ট সমূহ এদের জাতের উপর নির্ভরশীল। মুরগির বিভিন্ন জাত এর মাঝে সংকরায়নের মাধ্যমে আবার উন্নত মানে প্রোল্ট্রি মুরগি ও এর বিভিন্ন জাত তৈরী করা হয়। এজন্য জাত উন্নয়নে মূল জাতের মুরগী সংরক্ষন করা অত্যন্ত গুরুত্ববহন করে।