বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং হাঁস বা পেকিন হাঁস (Pekin Duck) খামার জনপ্রিয়তা পেয়েছে দ্রুত বৃদ্ধি, উন্নত মাংসের মান এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাজার উপযোগী হওয়ার কারণে। এই হাঁসের বাচ্চাগুলো সাধারণত একদিন বয়সে খামারে সরবরাহ করা হয়, যাদের পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করলে তিন মাসের মধ্যেই ভালো ওজন অর্জন করে বিক্রির উপযোগী হয়।
বাচ্চা গ্রহণ ও প্রাথমিক যত্ন
একদিন বয়সি বেইজিং হাঁসের বাচ্চা গ্রহণের পর প্রথম তিন দিনই পুরো পালনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় তাদের জন্য উষ্ণ ও শুকনো পরিবেশ নিশ্চিত করতে হয়। ঘরে পর্যাপ্ত তাপমাত্রা ও বাতাস চলাচল থাকতে হবে, কারণ ঠান্ডা বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রাখলে বাচ্চারা সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইনকিউবেটর থেকে বের হওয়ার পর সাধারণত ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উপযুক্ত থাকে, যা ধীরে ধীরে পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে কমানো যায়।
এই পর্যায়ে পরিষ্কার লিটার ব্যবহার করা জরুরি, যেমন শুকনো করাতের গুঁড়া বা শুকনো ঘাস। লিটার ভিজে গেলে সেটি প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হয়। হাঁসের বাচ্চারা সাধারণত দলে দলে একসাথে থাকে, তাই ঘরে পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হয় যেন ওভারক্রাউডিং না হয়। overcrowding এর কারণে শ্বাসকষ্ট, পা দুর্বলতা বা লেজ কাঁপা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
খাবার ও পানির যত্ন
বেইজিং হাঁসের বাচ্চারা জন্মের পর প্রথম একদিন শুধু পানি খেলেই চলে। এরপর ধীরে ধীরে তাদেরকে প্রাথমিক খাবার দিতে হয়, যেটি উচ্চ প্রোটিনযুক্ত এবং সহজে হজমযোগ্য। প্রারম্ভিক পর্যায়ে ব্রয়লার স্টার্টার বা বিশেষ হাঁসের বাচ্চার খাদ্য ব্যবহার করা যায়। বাচ্চারা পর্যাপ্ত পানি না পেলে খাদ্য হজমে সমস্যা হয়, তাই সবসময় পরিষ্কার ও ঠান্ডা পানি নিশ্চিত করতে হয়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁসের খাদ্যের ধরনও পরিবর্তন করতে হয়। গ্রোয়িং পর্যায়ে তাদের খাদ্যে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ও ভিটামিনের সঠিক ভারসাম্য রাখতে হয়। বাংলাদেশে অনেক খামার গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত প্রোটিন সরবরাহ করলে বেইজিং হাঁস ৬০ দিনের মধ্যে প্রায় ১.৮ থেকে ২ কেজি পর্যন্ত ওজন অর্জন করে।
ঘর ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা
হাঁসের বাচ্চার জন্য ঘর নির্মাণের সময় স্থান, তাপমাত্রা ও বাতাস চলাচলের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হয়। ঘর এমন স্থানে করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি জমে না এবং রোদ সহজে ঢুকে। শুষ্ক ও পরিস্কার পরিবেশে হাঁসের বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং রোগের ঝুঁকি কমে।
বেইজিং হাঁস মূলত ঠান্ডা পরিবেশ পছন্দ করে, তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় তাদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হয় না। তাই ঘর এমনভাবে বানাতে হবে যাতে গরমে হাওয়া চলাচল হয় এবং শীতে হালকা উষ্ণতা বজায় থাকে। প্রতিদিন ঘর পরিষ্কার রাখা, লিটার পরিবর্তন, ও বর্জ্য অপসারণ অত্যন্ত জরুরি। পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে হাঁসের মধ্যে কলেরা বা ভাইরাল সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
বাচ্চা অবস্থায় রোগ প্রতিরোধই হলো হাঁস পালন সফলতার মূল চাবিকাঠি। একদিন বয়সি বাচ্চা পাওয়ার পরপরই তাদেরকে উষ্ণ পরিবেশে রাখার পাশাপাশি ভিটামিন-মিশ্রিত পানি দিলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। হাঁসের ঘর নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং অসুস্থ হাঁস দ্রুত আলাদা করে চিকিৎসা নিতে হবে।
বাংলাদেশে সাধারণত হাঁসের কলেরা, প্যারাটিফয়েড এবং ভাইরাল সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। তাই স্থানীয় ভেটেরিনারি অফিস থেকে পরামর্শ নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর টিকা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পাশাপাশি খাদ্য ও পানি সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
বৃদ্ধি, ওজন এবং উৎপাদন
বেইজিং হাঁসের বাচ্চারা দ্রুত বাড়ে। সঠিক খাবার ও যত্ন পেলে তারা এক মাসে প্রায় ৭০০–৮০০ গ্রাম এবং দুই মাসে ১.৮ কেজি পর্যন্ত ওজন অর্জন করতে পারে। হাঁসের মাংসের মান নরম, রঙ সাদা এবং ফ্যাটের পরিমাণ কম হওয়ায় বাজারে চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি।
হাঁসের ওজন ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতি সপ্তাহে ওজন মাপা জরুরি। এতে খাদ্য ব্যয়ের সাথে উৎপাদন কার্যকারিতা তুলনা করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০টি হাঁস দিয়ে শুরু করলে তিন মাসের মধ্যেই ছোট পরিসরে লাভ পাওয়া সম্ভব।
বিপণন ও অর্থনৈতিক দিক
বাংলাদেশে বেইজিং হাঁসের মাংস এখন বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁয় নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে। তাই খামারিদের জন্য এটি একটি লাভজনক পেশা হয়ে উঠছে। ভালো খাবার, পরিচ্ছন্ন ঘর ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং বাজারে প্রতি হাঁসের বিক্রয়মূল্য তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়।
যারা নতুনভাবে হাঁসের বাচ্চা পালন শুরু করতে চান, তাদের জন্য পরামর্শ হলো ছোট পরিসরে কাজ শুরু করা এবং অভিজ্ঞ খামারিদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ানো যায়।