দেশি মুরগি পালন – বানিজ্যিকভাবে দেশি মুরগির খামার ব্যাবস্থাপনা

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী ও বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে দেশি মুরগি পালন। স্বল্প বিনিয়োগ, সহজ ব্যাবস্থাপনা ও ভালো বাজার দরের কারনে দেশী মুরগী পালন বর্তমানে বেকার যুবকদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে।

লাভজনকভাবে দেশি মুরগি পালন করতে হলে সঠিক পরিচর্যা ও খামার ব্যাবস্থাপনা সম্পর্কে ধারনা রাখতে হবে। আমরা এখানে দেশি মুরগি পালনের বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি দেশি মুরগি পালন প্রশিক্ষণ সম্পর্কে আপনার ধারনা সঠিক থাকবে।

দেশি মুরগি পালনের সুবিধা

দেশি মুরগি পালন দিন দিন বেশকিছু কারনে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। স্বল্প বিনিয়গে বেশি মুনাফা অর্জনে দেশি মুরগি পালন হতে পারে আদর্শ ব্যাবসা। অন্যান্য হাইব্রীড মুরগির তুলনায় দেশি মুরগি পালন করা সহজ।

অন্যান্য যেকোনো মুরগির তুলনায় দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো। ফলে দেশি মুরগির মৃত্যুহার কম। দেশি মুরগি পালনে ঔষধ খরচ তেমন একটা হয়না। তবে লাভজনক খামার গড়ে তুলতে চাইলে বায়োসিকিউরিটি ভালোভাবে মেনে চলতে হবে।

উচ্ছিষ্ট বা সাধারন মানের খাদ্যেও দেশি মুরগি জীবনধারন করতে পারে। প্রয়োজনীয় মিনারেল নিজে থেকেই চড়ে বেড়িয়ে সংগ্রহ করতে পারে। দেশি মুরগী পালনের অন্যতম সুবিধা হলো, এর খাদ্য খরচ কম।

সবথেকে আকর্ষনীয় বিষয় হলো, দেশি মুরগির বাজার চাহিদা। সাধারণত ব্র্রয়লার বা কক মুরগির মত দেশি মুরগির বাজারদর কমে যায়না। সারা বছরই দেশি মুরগির বাজার দর ভালো থাকে।

দেশি মুরগির জাত নির্বাচন

দেশি মুরগি বলতে আমরা একটি নির্দিষ্ট মুরগি বুঝালেও আসলে দেশি মুরগির কয়েকটি জাত রয়েছে। আমাদের দেশে প্রাপ্ত যেমন, গলাছিলা, হিলি, অসিল সহ কমন দেশি মুরগির জাত রয়েছে। এগুলির একেকটির একেক রকম জাতগত বৈশিষ্ট রয়েছে।

আমাদের দেশে সরকারি ভাবে দেশি মুরগির জাত উন্নয়ন নিয়ে কাজ হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বি,এল,আর,আই কমন গলাছিলা ও হিলি মুরগির জাত উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করে দেশি মুরগির খামার করা যেতে পারে।

দেশি মুরগি পালন পদ্ধতি

দেশী মুরগী পালনের কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। যেমন,

  • সম্পূর্ন আবদ্ধ অবস্থায়
  • আংশিক আবদ্ধ
  • উন্মুক্ত বা সম্পূর্ন খোলা-মেলা পরিবেশ।

সাধারন ভাবে আমাদের দেশে দেশি মুরগি উন্মুক্ত বা খোলা-মেলা পরিবেশেই বেশি পালন করা হয়ে থাকে। তবে কমার্শিয়াল বা ব্যাবসায়িক ভাবে এই পদ্ধতি তেমন লাভজনক নয়।

আবার যেহেতু দেশি মুরগি প্রকৃতিগত ভাবে চঞ্চল ও চড়ে বেড়ানো স্বভাবের তাই এদেরকে সম্পূর্ন আবদ্ধ অবস্থায় ফার্মের মত করে পালন করাও উচিত নয়। সম্পূর্ন আবদ্ধ অবস্থায় দেশি মুরগি পালন করা হলে এটি এর গুনগত বৈশিষ্ট ক্রমান্বয়ে হারাতে থাকবে।

প্রোল্ট্রি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশি মুরগিকে আংশিক আবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন করা সবথেকে উত্তম। এক্ষেত্রে দেশি মুরগির জন্য থাকার ঘর বা শেড ও পাশাপাশি চড়ে বেড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত উন্মুক্ত পরিবেশ দিতে হবে।

দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেশি মুরগি চড়ে বেড়িয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও মিনারেল সংগ্রহ করবে। এর ফলে মুরগি পালনের খাদ্য খরচও কমে আসবে।

যেভাবে দেশী মুরগির ঘর প্রস্তুত করবেন

দেশী মুরগী পালনে ঘর হবে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর লম্বা। প্রস্থ সাধারনত ২০ থেকে ২৫ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ১৫০ ফুট বা চাহিদা অনুযায়ী করা যেতে পারে।

মুরগির ঘরের মেঝে হবে মাটি থেকে কমপক্ষে এক ফুট উচুতে এবং চারপাশ ভালোভাবে নেট দিয়ে ঘেরা দিতে হবে। খেয়াল রাখা প্রয়োজন, বাহিরহতে কোন কিছু যেন শেডে প্রবেশ করতে না পারে।

মাঝারী আকারের দেশি মুরগি পালনে প্রতিটি মুরগির জন্য ০.৮৫ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। অর্থাৎ, ৫০০ দেশি মুরগির জন্য ৪২৫ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। তবে পূর্ন বয়সের বা ডিমের জন্য পালন করলে মুরগি প্রতি কমপক্ষে ১.৫ বর্গফুট জায়গা দিতে হবে।

আংশিক আবদ্ধ পদ্ধতিতে পালন করলে চারপাশ ভালোভাবে নেট দিয়ে ঘেরা দিতে হবে। চড়ে বেড়ানোর স্থানে যেন শিয়াল, বেজি, ইদুর ইত্যাদি প্রবেশ করতে না পারে।

দেশি মুরগির বাচ্চা পালন পদ্ধতি

বাচ্চা উঠানোর পূর্বে ব্রুডার ঘরের সমস্ত জিনিস ভালোভাবে পরিস্কার করে নিতে হবে। ভালোবভাবে ব্রুডার তৈরি করতে হবে। ঘরের চারপাশে কাপরের পর্দা দিতে হবে।

বাচ্চা আসার ১০ মিনিট আগেই পানির পাত্র এবং খাবার পাত্র যথাযথ জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে। ঘরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে।

প্রথম দুই ঘন্টা শুধুমাত্র জীবানুমুক্ত সাদা পানি দিতে হবে। দুর্বল বাচ্চা পৃথক করে গ্লুকোজের পানি ফোটায় ফোটায় খাইয়ে দিতে হবে।

ব্রুডারে ছাড়ার ১০ মিনিট পর খাবার দিতে হবে। এক্ষেত্র শুধুমাত্র প্রথমবার পেপারে ছিটিয়ে দিয়ে পরে অবশ্যই ট্রেতে খাবার দিতে হবে।

বাচ্চার অবস্থা ৩ ঘন্টা পরপর পর্যবেক্ষণ করতে হবে দেখতে হবে তাপ বেশী হচ্ছে কিনা। কোন সমস্যা থাকলে সমাধান করতে হবে এবং বাচ্চা মৃত থাকলে সরিয়ে ফেলতে হবে।

খাবার পানি শেষ হলে খাবার পানি দিতে হবে। পেপার ভিজে গেলে পাল্টে দিতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর পেপার সম্পূর্ন ভাবে সরিয়ে ফেলতে হবে।

দেশি মুরগিকে প্রথম একমাস পর্যন্ত ভালোভাবে যত্ন নিতে হবে এবং বাহিরে ছাড়া যাবেনা। সকল প্রকার শিকারি প্রানী বিশেষ করে কাক-শকুন, বিড়াল, বেজি ইত্যাদি থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

দেশী মুরগীর খাদ্য তালিকা

লাভজনকভাবে দেশি মুরগি পালনে জন্য খাদ্য খরচ কমিয়ে আনা জরুরী। বাজারে প্রাপ্ত সোনালী ফিডের সাথে দানাদার জাতীয় খাদ্য দিতে হবে।

চড়ে বেরিয়ে দেশি মুরগি নিজে থেকেই ঘাস, শাক-সবজি ও লতাপাতা খেয়ে থাকে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় মিনারেল এরা নিজে থেকেই সংগ্রহ করতে পারে।

শুধুমাত্র ফিড খাইয়ে দেশি মুরগি পালন করলে এর মাংসের স্বাদ ও গুনগত বৈশিষ্ট লোপ পায়। ফলে উপোযুক্ত বাজার দর পাওয়া যায়না।

অপরদিকে শুধুমাত্র দানাদার খাদ্য প্রয়োগ করেও কাংখিত ওজন পাওয়া যায়না। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ ৬০ ভাগ ফিড ও বাকি ৪০ ভাগ দানাদার খাদ্য দেয়া যেতে পারে।

দানাদার খাদ্য হিসেবে ধান, চালের খুদ, গম, ভুট্টা ভাঙ্গা, বিভিন্ন ডাল ও শষ্যদানা দেয়া যেতে পারে।

দেশি মুরগির রোগ ও চিকিৎসা

অনেকের ধারনা দেশি মুরগির রোগ বালাই হয়না। জিনগত ভাবে দেশি মুরগি পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নিতে পারলেও বেশ কিছু রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

নিয়মিত টিকা প্রাদান ও যথাযথ ভিটামিন মিনারেল প্রয়োগ করলে দেশি মুরগি তেমন রোগাক্রান্ত হয়না।

এখানে দেশি মুরগির রোগ ও চিকিৎসা বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেয়া হলো।

রানীক্ষেত

দেশি মুরগিতে রাণীক্ষেত রোগের লক্ষণ সচারচর বেশি দেখা যায়। এ রোগ হলে মুরগী খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মাথা নিচু ও চোখ বন্ধ করে ঝিমাতে থাকে। সাদা চুনের মত পাতলা মল ত্যাগ করে। নাক দিয়ে সর্দি ও মুখ দিয়ে লালা ঝরে।

সঠিকভাবে নিয়মিত টিকা প্রদান করলে রাণীক্ষেত রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।

আরো জানতে পড়ুনঃ দেশি মুরগির ভ্যাকসিন সিডিউল

গামবোরো

দেশি মুরগির আরেকটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ হচ্ছে গামবোরো। বিরনা নামক এক ভাইরাসের ফলে এই রোগ হয়ে। সাদা চুনের মত বিষ্ঠা ত্যাগ করে বলে, গ্রামাঞ্চলে এটি চুনারোগ বলেও পরিচিত।

গামবোরো রোগের জন্য টিকা বা ভ্যাকসিন দিতে হবে।

কেন গামবোরো হয়? এই রোগের লক্ষন ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পড়ুনঃ মুরগির রোগ ও চিকিৎসা – গামবোরো

রক্ত আমাশয়

দেশি মুরগির অন্যতম একটি রোগ হচ্ছে রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস। সাধারনত এটি বাচ্চা মুরগিকেই বেশী ক্ষতি করে। তবে যেকোন বয়সের দেশি মুরগির এটি হতে পারে। এই রোগ সাধারনত বিষ্ঠার মাধ্যমে ছড়ায়।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টল্ট্রাজুরিল বা এম্প্রোলিয়ায়ম জাতীয় ঔষধ ব্যাবহার করা যেতে পারে।

ফাউল পক্স

ফাউল পক্স একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। দেশি মুরগির যে কোন বয়সেই ফাউল-পক্স হতে পারে। তবে বাচ্চা অবস্থায় আক্রান্ত হলে বেশি মারা যায়।

সাধারণত শরীরের পালক বিহীন জায়গায় সাধারণত শক্ত গোটা উঠে এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এই রোগে মুরগির দেহে জ্বর আসে।

চিকিৎসা হিসেবে যথাসময়ে ফাউল-পক্স এর টিকা প্রদান করতে হবে।

ফাউল কলেরা

কলেরা একটি পানি বাহিত রোগ। কলেরা হলে মুরগি সবুজ তরল মল ত্যাগ করে। খাদ্য কম খায় এবং ডিম পারা বন্ধ করে দেয়।

কলেরা রোগের সরকারি টিকা রয়েছে। এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সালফার জাতীয় ড্রাগ দেয়া যেতে পারে। প্রোবায়োটিকের মাধ্যমে এই রোগটি নিয়ন্ত্রন করা যায়।

দেশী মুরগী পালনের ব্যাবসায়ীক হিসাব

এখানে আমরা ৫০০ দেশি মুরগি পালন এর আয়-ব্যায়ের সম্ভাব্য হিসেব করেছি। সময় ও বাজারদর তারতম্যে এই হিসেব পরিবর্তনযোগ্য ।

এককালীন খরচ

খরচের খাতমূল্য টাকায় (আনূমানিক)
ঘর তৈরি (টিনের সেমি পাকা) ৫০,০০০৳
খাদ্য ও পানির পাত্র ৩,৫০০৳
ব্রুডার সরঞ্জামদি ও পর্দা ১,৫০০৳
মোট৫৫,০০০৳
এককালীন খরচ

৫০০ দেশি মুরগি পালনে খরচের হিসাব

খরচের খাত মূল্য টাকায় (আনূমানিক)
একদিনের বাচ্চা (৫০০ পিছ * ৩০৳)১৫,০০০৳
মোট খাদ্য (৫০ কেজি *২০বস্তা * ৪০৳)৪০,০০০৳
মেডিসিন২,৫০০৳
ভ্যাকসিন ৮০০৳
লিটার ১,২০০৳
বৈদ্যুতিক বিল১,০০০৳
মোট ৬০,৫০০০৳
৫০০ দেশি মুরগি পালনে খরচের হিসাব

বিঃদ্রঃ এখানে বাজারে বিক্রয় উপযোগি দেশি মুরগী পালন এর হিসেব দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য বাচ্চা, খাদ্য সহ অন্যান্য খরচের খাত সমূহের দাম পরিবর্তনশীল। এখানে শুধুমাত্র ধারনা দেয়া হয়েছে।

দেশি মুরগি পালনে আয়ের পরিমান (সম্ভাব্য)

৫০০ মুরগির ওজন ৪৫০ কেজি (±৫০) * ২৫০৳ = ১,১২,৫০০৳ (± ১০,০০০৳)

অর্থাৎ ৫০০ দেশি মুরগি পালনে সম্ভাব্য লাভের পরিমান প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এই লাভের পরিমান বাজার দরের পরিবর্তনে কমবেশি হতে পারে।

দেশি মুরগির লাভজনক খামার ব্যাবস্থাপনা

লাভজনকভাবে দেশি মুরগির খামার করতে চাইলে সঠিক ব্যাবসায়ীক হিসেব-নিকেশ এর নিকল্প নেই। যেহেতু আমাদের দেশে বাজারদর ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে থাকে তাই বাজারদর সম্পর্কে ধারনা রাখতে হবে।

যথাসম্ভব খাদ্য খরচ কমিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি বায়োসিকিউরিটি মেনে চলতে হবে এবং মুরগীকে সুস্থ রাখতে হবে।

আশাকরি দেশি মুরগি পালন সম্পর্কে আপনি একটি ধারনা পেয়েছেন। আপনার মতামত আমাদের জানাতে কমেন্ট করতে পারেন। শুভকামনা রইলো।

10 thoughts on “দেশি মুরগি পালন – বানিজ্যিকভাবে দেশি মুরগির খামার ব্যাবস্থাপনা”

    • পূর্ন বয়স্ক (৬ মাস+) দেশি মুরগি দৈনিক ১১০ থেকে ১২০ গ্রাম খাদ্য গ্রহন করে থাকে। যার ৬০% প্রাদান করতে হয় আর বাকি ৪০% মুরগি নিজে থেকে সংগ্রহ করতে পারে। ( ছাড়া থাকলে)

      ধন্যবাদ আপনাকে।

      Reply
      • আপনার হিসাবে কত মাস পালন করতে হয়। আমরা শুনি ৭০দিন /৭৫দিন/৩মাস।

        Reply
  1. জনাব,এই খাদ্য খরচ টি মুরগির কত দিন বয়স ধরে হিসাব করেছেন??
    বললে উপকৃত হবো।

    Reply
  2. আপনার এই চমৎকার লেখাটি অনেকের উপকারে আসবে।

    Reply

Leave a Comment