টার্কি মুরগি পালন করার আগে টার্কি মুরগি পালনের বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে সঠিক ধারনা থাকা জরুরি। কম খাদ্য খরচ ও ভা্লো রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় টার্কি পালন দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
টার্কি মূলত উত্তর আমেরিকার একটি বন্য পাখি। স্পেনিশরা এটিকে মেক্সিকো থেকে ইউরোপে নিয়ে যায় এবং গৃহপালিত পাখি হিসেবে পোষ মানায়। তারপর এটিকে সাথে করে বিভিন্ন উপনিবেশ গুলোতে নিয়ে আসে। আমেরিকা,কানাডা,যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স,নেদারল্যান্ড, ইটালি ইত্যাদি দেশে টার্কি পালন জনপ্রিয়।
আমাদের দেশে হাঁস-মুরগি ও কোয়েলের পরই টার্কির স্থান। বাংলাদেশে মূলত মাংসের জন্য টার্কি পালন করা হলেও অনেকে সৌখিনতার জন্য টার্কি পালন করে।
টার্কি মুরগি পালনের সুবিধা
টার্কি মুরগি আমাদের দেশের আবহাওয়ায় সম্পূর্ন অভিযোজিত হয়েছে। অন্যদিকে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব ভালো। দেশি মুরগির মত খোলা পদ্ধতিতে পালন করা যায় ফলে টার্কি পালনে খাদ্য খরচ তুলনামূলক কম। সাধারণত এরা লতা পাতা, ঘাস, কলমিশাক, বাধাকপি, হেলেঞ্চা ইত্যদি খায়।
সবথেকে ভালো বিষয় হলো এরা খুব দ্রুত বাড়ে ও সাত-আট কেজি অনায়াসেই হয়। এদের মাংসের গুনগত মান ভালো। এছাড়াও নতুন সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি হিসেবে এর বানিজ্যিক গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
টার্কি মুরগির বৈশিষ্ট্য
টার্কি মুরগির গায়ের রং সাধারণত লাল,কালো,সাদা হয়ে থাকে। পাখি হিসেবে এরা মাঝারি থেকে বড় আকৃতির হয়ে থাকে। সাধারনত ২০ সপ্তাহে মেল টার্কির ওজন ৭ কেজি ও ফিমেল টার্কির ওজন ৫.৫ কেজি হয়ে থাকে। তবে অনেক জাত ১০-১২ কেজি পর্যন্ত হয়।
ব্রিডিং এর জন্য মেল-ফিমেল টার্কির অনুপাত হবে ১ঃ৫। তবে এদের মিটিং সাকসেস কম। এআই করলে ডিমের হ্যাচিবিলিটি ভালো আসে। ডিমের ওজন ৬৫ গ্রাম ও বাচ্চার ৫০গ্রাম। টার্কি মুরগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা দেশি মুরগির মত।
একটি বড় টার্কি মাসে প্রায় ৪-৫ কেজি ও দিনে ১৪০-১৫০ গ্রাম খাদ্য খায়। শাক-সব্জি ও লতাপাতা বেশি পছন্দ করে। সাড়ে তিন থেকে চার মাসে মেল-ফিমেল চেনা যায়। সাধারণত বছরে ৮০-১০০ টি ডিম দিলেও, কোন কোন সময় ১২০-১৬০ টি ডিম দেয়।
টার্কি মুরগির বাসস্থান
স্থান নির্বাচন করা সব থেকে একটি গুরুত্ব পূর্ণ একটি বিষয়। সর্বপ্রথম উচু জায়গা নির্বাচন করতে হবে কারণ বৃষ্টি হলে খামারে পানি জমতে পারে । বাশ , টিন ,তার ইত্যাদি দিয়ে ভাল ভাবে বাসস্থান তৈরী করতে হবে । লোকালয় থেকে দুরে তৈরী করতে হবে যাতে মুরগির রোগ কম হয়। যাতায়াত ব্যাবস্থার সুবিধা থাকতে হবে যাতে করে সহজে গাড়ি যেতে পারে আপনার খামারে । পানি ,খাবার , বিদ্যুৎ এর সুবিধা থকতে হবে ।
টার্কি মুরগির বাসস্থান তৈরীতে মুরগি প্রতি ১.৫ থেকে ২ বর্গ ফুট জায়গা প্রদান করতে হয়। চড়ে বেড়ানোর জন্য তৃণভূমি থাকলে শেডের যায়গা কম রাখা যেতে পারে।
উন্মুক্ত বা বদ্ধ উভয় পদ্ধতিতেই টার্কি মুরগি পালন করা যায়। তবে উন্মুক্ত অবস্থায় বেশি ওজন আসে এবং ভাল থাকে। খরচও কম হয়।
ব্রুডিং–
নতুন ফোটা মুরগির বাচ্চা গুলির শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে, তাই পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে মুরগির শরীরের তাপমাত্রাকে সমন্বয় করতে এই ধরণের বাচ্চা গুলিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি স্থানে রেখে ২ থেকে ৩ সপ্তাহের জন্য কৃত্রিমভাবে তা দিতে হয়। এই কৃত্রিম তাপকে ব্রুডিং বলা হয়। ব্রুডিংয়ের উদ্দেশ্য হ’ল বাচ্চা গুলির জন্য একটি আরামদায়ক এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা।
টার্কি মুরগির বাচ্চা ব্রুডিং এর সময় লিটারে পালন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাচ্চা শেডে আসার আগে লিটারের উপাদান যেমন, তুস, কুড়া ,বালি ,ছায় ইত্যাদি ছড়িয়ে দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। শুকনো, পরিষ্কার লিটারের উপাদান ১ থেকে ২ ইঞ্চি পুরু মেঝেতে ছড়িয়ে দিতে হবে।
ব্রুডিংয়ের সময় পরিবেশ পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারলে মুরগির শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস, খাদ্য রূপান্তর হার হ্রাস, এবং অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাবে। ফলস্বরূপ খামারের লাভ হ্রাস পাবে। সব জাতের হাঁস-মুরগির ব্রুডিং ম্যানেজমেন্ট প্রায় একই রকম।
ব্রুডিং এর তাপমাত্রা
- ১ম সপ্তাহে ৯৫’ ফারেনহাইট
- ২য় সপ্তাহে ৯০
- ৩য় সপ্তাহে ৮৫
- ৪থ সপ্তাহে ৮০
- ৫ম থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৫ ‘ ফারেনহাইট
লিটার ব্যাবস্থাপনাঃ
লিটার উপাদানগুলি কোনও ধরণের দূষিত কিনা তা দেখে ব্যবহার করা উচিত। কীটনাশক লিভার এবং কিডনির ক্ষতি করে এবং পেশী এবং ফ্যাটগুলিতে জমা হয়। ছত্রাক গুলি বায়ুতে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাচ্চা গুলি যখন শ্বাস নেয় তখন তারা সংক্রামিত হয় এবং মারা যায়। যদি লিটার কোনও কারণে ভেজা হয়ে যায় বা অন্য কোনও কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তবে শুকনো লিটারটি দ্রুত প্রতিস্থাপন করা উচিত।
খাদ্য ব্যাবস্থাপনাঃ
হেরিটেজ টার্কি আংশিক খোলা পদ্ধতিতে পালন করা লাভজক। এই পদ্ধতিতে টার্কি পালন করলে খাদ্য খরচ কম হয়। সাধারণত এরা লতা পাতা, ঘাস, কলমিশাক, বাধাকপি, হেলেঞ্চা ইত্যদি শাক খেয়ে থাকে।
টার্কি মুরগির খাবার তালিকায় মোট খাদ্যের ২৫% থেকে ৫০% পর্যন্ত দানাদার খাদ্য দেয়া যেতে পারে।বানিজ্যিক বা সম্পূর্ন আবদ্ধ পরিবেশে টার্কি পালনে সাধারণত ৩ থেকে ৪ ধরনের খাদ্য দেয়া হয়। এর ফিড ফরমুলেশন পদ্ধতি অনেকটাই ব্রয়লার মুরগির মত।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন…
লাইটিংঃ যদি ডিম পাড়া মানে ব্রিডার হিসেবে পালন করা হয় তাহলে লেয়াররের মত লাইট দিতে হবে।
টার্কি মুরগির রোগ সমূহ
টার্কি মুরগির বিভিন্ন ধরেনের রোগ বালাই হয়ে থাকে যেমনঃ-
- সালমোনেলোসিস(সালমোনেলা এরিজোনা) সালমোনেলা মুক্ত ব্রিডার থেকে আনতে হবে।
- প্যারাটাইফয়েড(সালমোনেলা পুলোরাম) এ আই এরিসিপেলাসঃ হঠাত মারা যায়,মুখের রং পরিবর্তন
- নিউমোনিয়া ব্লেক হেডঃ(হিস্টোমোনিয়াসিস) ১২ সপ্তাহের কম বয়সে হয়।পানি বেশি খায়।বেশি মারা যায়।
- ব্লুকম্ব বা টার্কি কড়োনা ভাইরাসঃ শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়।হঠাত মারা যায়,মৃত্য হার ৫০-৯০%।
- ফাউল কলেরা (Fowl cholera) – মৃত্য হার ৬০-৯০%,৬ সপ্তাহের বেশি বয়সে হয়,পানি বেশি খায়।
- আমাশয় ও রানিক্ষেত মাইল্ড রুপে হয়।
- কৃমি( গেপ ওয়াম বা রেড ওয়াম,), নাভিকাচা।
- সাইনোসাইটিস (ব্যাক্টেরিয়াল ডিজিজ)
- মাইকোপ্লাজমোসিস: মাইকোপ্লাজমা গ্যালিসেপ্টিকাম ও সাইনোভি(১০-১২ সপ্তাহে বেশি হয়)
- হেক্সামাইটিয়াসঃ ৩-৮ সপ্তাহে হয়।
- মাইকোটক্সিকোসিস টার্কির যৌন রোগ(মাইকোপ্লাজমা মেলিয়াগ্রেডিস) ফারটিলিটি ও হ্যাচিং রেট কমে যায়।
- টার্কি করাইজা(ব্রডেটেলা এভিয়াম)
- পক্স এবং মাইটস এবং উকুন।
- লিউকোসাইটোজোয়ান পায়ের বিভিন্ন রোগ ;
- প্যারলাইসিস মেরেক্স,গাম্বোরু ও ব্রংকাইটিস তেমন হয় না।
টার্কি মুরগির ভ্যাকসিন সিডিউল
রোগ বালাই কম হলেও ঝুকি না নিয়ে সময়সূচী অনুসারে টিকাদান করতে হবে। টার্কি মুরগির ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানতে নিচের ছকটি অনূসরণ করতে পারেন।
বয়স (দিন) | রোগের নাম | ভ্যাকসিনের নাম | ভ্যাকসিনের প্রকৃতি | প্রয়োগ পদ্ধতি |
১-৩ | রানীক্ষেত | এনডি | লাইভ | এক চোখে এক ফোঁটা |
৩৫-৪০ | ফাউল পক্স | ফাউল পক্স | লাইভ | ডানায়সূচ ফুটানোর মাধ্যমে |
৬০-৭০ | রানীক্ষেত | এনডি | লাইভ | এক চোখে এক ফোঁটা |
৭৫-৮০ | ফাউল কলেরা | ফাউল কলেরা | কিল্ড | ঘাড়ের চামড়ার নিচে ইনজেকশন |
১১০-১১৫ | রানীক্ষেত | এনডি কিল্ড | কিল্ড | ঘাড়ের চামড়ার নিচে ইনজেকশন |
আরো জানতে পড়ুন…
টার্কি মুরগি আমাদের দেশের জলবায়ুতে সহনশীল মুরগি। তদপুরী এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ভালো। আমাদের দেশের বেকার যুবক-যুবতির একটি অন্যতম উদ্যোক্তা হওয়ার খাত হিসেবে এটি রয়েছে। তবে টার্কি মুরগি পালনের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সাধারন জনগণেরর কাছে এটি এখনও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অভিজ্ঞ ডাক্তার ও এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা কম। বিশেষ করে খাবার, লাইটিং, ওজন, ফিড ফরমুলেশনে ধারণা নেই। তবে আশার কথা দিনে দিনে টার্কি পালন নিয়ে মানুষের মাঝে পজিটিভ চিন্তাধারা চালু হয়েছে।
সঠিকভাবে জেনেবুঝে বিনিয়োগ করলে টার্কি পালন হতে পারে অন্যতম আয়ের উৎস।