ক্রয়লার বা কয়লার মুরগি ‘দ্বৈত উদ্দেশ্য’ মুরগির একটি হাইব্রিড জাত যা ভারতে ডেভেলপ করা হয়েছিলো। এটি নব্বই’র দশক এর প্রথম দিকে ভারতের বিখ্যাত ‘কেগ ফার্মস প্রাইভেট লিমিটেডের’ বিনোদ কাপুর এর তত্বাবধনে ডেভেলপ করা হয়েছিল। ‘ক্র+অয়লার বা ক্রয়লার ‘ নামটি কেগ এবং ব্রয়লারের (Kegg +Broiler) সমন্বয়ে দেওয়া হয়েছিল।
“রোড আইল্যান্ড রেড” বা RIR মুরগির সাথে “হোয়াইট লেগহর্ন” এর মোরগ বা RIR মুরগির সাথে রঙিন ব্রয়লার মোরগের সাথে ক্রস করে জাতটির প্রথম স্ট্রেইন তৈরি করা হয়।
এরপর এদের ডিম বাচ্চা ফুটানোর মেশিন বা ইনকিউবেটরের বদলে সারা দেশে (ভারতে) প্রাকৃতিকভাবে এক হাজারেরও বেশি তা দেয়া দেশী মুরগির নীচে ডিম রেখে বাচ্চা ফুটানো হয়। তারপর বাচ্চাগুলি পৃথক পৃথক গ্রামে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। দ্রুতই এই জাতটি ভারতের বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র চাষী বা ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ অঞ্চলে এটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে; ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মেঘালয়, মিজোরাম, উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। পরবর্তিতে জাতটি বাংলাদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
প্রথমদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এটির বেশ কিছু ফার্ম গড়ে উঠে এবং তা দ্রুতই সারা দেশে ছড়িয়ে যায়। অঞ্চলভেদে ক্রয়লার মুরগী বেশ কিছু নামে পরিচিতি পায়। যেমন, টাইগার, স্যাসো, সিপিএফ ইত্যাদি। যদিও এগুলি প্রতিটি আলাদা জাতের মুরগি।
মূলত গ্রামীণ নারীদের সাবলম্বি করার উদ্যশ্যে জাতটি কেগ ফার্ম ডেভেলপ করেছিলো। কিন্তু বর্তমানে এই জাতের মুরগি পালন করা লাভজনক হয়ে উঠছে এবং প্রচুর বানিজ্যক ফার্ম গড়ে ঊঠছে।
ক্রয়লার মুরগীর সাফল্যের কারনে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে যেমন, কেনিয়া ও উগান্ডা ইত্যাদি রপ্তানি করা হয়েছে।
নীচে ক্রয়লার মুরগীর বিবরণ পর্যালোচনা করা হলো।
ক্রয়লার মুরগির বিস্তারিত
ক্রয়লার মুরগি মাংস- ডিম উভয় উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত জাত (dual purpose)। এরা অল্প খাদ্যে, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট ও বর্জ্য খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। যেখানে স্থানীয় দেশি মুরগি বছরে মাত্র ৪০-৫০ টির মত ডিম দেয়, সেখানে ক্রয়লার মুরগি কৃষি ও রান্নাঘরের বর্জ্য খেয়ে বছরে প্রায় ১৫০ মত ডিম উৎপাদন করে।
অপরদিকে দেশি মুরগী ওজনে সাধারনতকম হলেও ক্রয়লার মোরগ প্রায় ৩.৫ কেজি এবং মুরগি প্রায় ২.৫ কেজি হয়। বানিজ্যকভাবে পালন করলে আরো ভালো ফলাফল আসে।
কয়লার মুরগি অনন্য জেনেটিক বৈশিষ্টের কারনে অসম্ভব রোগ প্রতিরোধী হয়। এই জাতটি পরিবারের সম্ভাব্য জৈব-রূপান্তরকারী, কোন খাদ্য খরচ ছাড়াই প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে গ্রামীণ মানুষের জন্য যথেষ্ট প্রোটিনের যোগান দিতে পারে। সাথে সাথে স্বল্প আয়ের পরিবারের জন্য যথেষ্ট আয়ও করতে পারে।
এরা ঘন ঘন খাবার খায় এবং খুব দ্রুত বাড়ে। ক্রয়লার মুরগি খুব একটা কুঁজো (broody) হয় না।
সাধারণত ক্রয়লার ৫ মাস বয়সে ডিম দেয়। তবে সাড়ে তিন থেকে চার মাসেও ক্রয়লার ডিমে আসতে পারে। একাধারে এটি প্রায় ২ বছর ডিম দিয়ে থাকে। ক্রয়লার মুরগির ডিম বেশ বড় এবং সুস্বাদু। ডিমের রং বাদামী খয়েরী ও গাড় হলুদ কুসুম ডিমের বেশি পরিমান জুড়ে থাকে।
আচরণ/মেজাজঃ
ক্রয়লার মুরগি নমনিয় এবং শান্ত প্রকৃতির। তবে মোরগ মাঝে মাঝে একটু-আধাটু আক্রমণাত্মক হতে পারে। এই জাতের মুরগি বদ্ধ-আবদ্ধ উভয় পরিবেশে পালনের উপযুক্ত। বিষেশ করে গ্রামীণ পরিবেশে, সাধারন প্রাকৃতিক খাদ্যেও ক্রয়লার জাতটি পালন করা যায়।
ক্রয়লার মুরগি (Kruiler Chicken) | জাতের তথ্য
জাতের নাম | ক্রয়লার (Kuroiler) |
অন্য নাম | কয়লার, টাইগার। |
পালনের উদ্দ্যেশ্য | মাংস এবং ডিম উভয় বা দ্বৈত-উদ্দেশ্য (Dual-Purpose) |
জাতের আচরণ | শান্ত, ঘনঘন খাবার খায়, হালকা মেজাজ ,সহজে পালন। |
আকার | ভারী। সাধারণত ২.৮ থেকে ৪.৫ কেজি। |
তা দেয়ার প্রবণতা | তেমন প্রবণতা নেই। |
ডিমর রঙ | বাদামী ক্রীম। |
ডিমের আকার | বড়। |
ডিমউৎপাদনশীলতা | ৭০% |
বৈচিত্র্য | বিভিন্ন কালারের। |
জলবায়ু সহনশীলতা | সব জলবায়ু (খুব শক্তসমর্থ)। |
ঝুঁটি | মাঝারী, একক ঝুঁটি। |
উৎপত্তিস্থল | ভারত। |
পালনের সুবিধাজনক দিকঃ
- খুব ভালো রোগ প্রতিরোধী ও শক্ত জাতের ।
- দ্রুত ম্যাচিউর হয়।
- কম খাদ্য লাগে।
- ২ মাসে গড়ে প্রায় ১২৫০ গ্রাম হয়।
- বেশ বড় হয়।
- অনেক মাংস হয়।
- মাংস খুব সুস্বাদু ।
- শান্ত স্বভাবের; আক্রমনাত্মক নয়।
- অন্যান্য মুরগির সাথে পালা যায়।
- বড় আকারের ডিম পাড়ে।
- বলিষ্ঠ পাখি।
- উড়াউড়ি করেনা।
পালনের অসুবিধাজনক দিকঃ
- মোরগগুলি সামান্য আক্রমনাত্মক হয়।
- কখনও কখনও অন্যান্য মুরগির উপর চড়াও হতে পারে।
- ডিমে উর্বরতা কম আসে।
- মোরগগুলি খুব জোরে শব্দ করে।
ক্রয়লার মুরগি কি আপনার পালনের উপোযুক্ত ?
ক্রয়লার মুরগির জন্য আপনার জন্য ভাল, যদি আপনি……
- বেশ মাংস দেয়, এমন জাতের মুরগি পালতে চান।
- বড় বাদামী ডিম উৎপাদন করতে চান।
- শক্ত জাতের, ভালো রোগ-প্রতিরোধ সম্পন্য মুরগি পালতে চান।
- কম খাদ্য ব্যবহার করে মুরগি পালতে চান।
- আপনার রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে মুরগি পালতে চান।
- একই সাথে ডিম ও ভালো মাংস হয়, এমন জাতের মুরগি পালতে চান।
- গ্রাম্য পরিবেশে ভালো এমন মুরগি পালতে চান।
- সব জলবায়ুতে বেঁচে থাকতে পারে এমন শক্ত জাতের মুরগি পালতে চান।
- একটি ভাল জাতের দ্বৈত-উদ্দেশ্য (dual purpose) মুরগী পালতে চান।
- দ্রুত সময়ে রোস্ট উপোযগী মুরগী পালতে চান(মাত্র ৪০ দিনে ১ কেজি)।
- ব্রয়লার, সোনালী ফার্ম করে লস খেয়ে থাকলে।
আরো পড়তে পারেন..
বাংলাদেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন দেশী মুরগি ও তার বৈশিষ্ট্য
ফাউমি মুরগি সম্পর্কে দরকারী তথ্য