গতপর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম কালারবার্ড মুরগীর খামার ব্যবস্থাপনা নিয়ে। আজকে আমরা আলোচনা করবো ‘কালারবার্ড মুরগীর রোগা-বালাই’ সম্পর্কে। গত পর্বে আমরা জেনেছিলাম যে, অন্যান্য মুরগীর তুলনায় কালারবার্ড মুরগীর রোগ-বালাই অনেকাংশে কম হয়। কথা সত্য, কিন্তু তারপরেও কিছু সাধারণ রোগ-বালাই তো আছেই, যা সকল মোরগ-মুরগীর ক্ষেত্রেই হয়। কালারবার্ড মুরগীরও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আজকের ব্লগ থেকে আমরা কালারবার্ড মুরগীর রোগ-বালাই সম্পর্কে নিন্মলিখিত বিষয়গুলো জানবো।
কালারবার্ড মুরগীর রোগগুলোকে মোটাদাগে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি।
- সচারচর হয়ে থাকে এমন রোগ।
- সচারচর হয় না এমন রোগ।
- সচারচর হয় এমন রোগ:
কালারবার্ড মুরগী পালন করতে গিয়ে খেয়াল করলাম, কিছু রোগ আছে যা প্রতিবারই হয়।
ঠাণ্ডা এদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান। তাছাড়াও কালারবার্ড মুরগীর নিম্মলিখিত রোগসমূহ হয়ে থাকে।
- এন্টারাইটিস
- আমাশয় বা রক্ত আমাশয়।
- সচারচর হয় না এমন রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
- রাণিক্ষেত
- গাম্বুরো।
- ব্রঙ্কাইটিস
এখন আমরা এসকল রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
কালারবার্ড মুরগীর ভ্যাকসিনের নাম ও তালিকা:
প্রথমেই আসি রাণিক্ষেত আর গাম্বুরো রোগের বিষয়ে। এই দুইটি রোগ ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। আর এজন্য এদের প্রতিকার ব্যবস্থা এখনো আবিষ্কৃত হয় হয়নি। এই দুই রোগে আক্রান্ত হলে ব্যাপক হারে মুরগী মারা যেতে পারে। ফলে খামারিদের লাভ কম হয়। অনেক ক্ষেত্রে লসও গুণতে হয়।
যেহেতু এই রোগগুলোর চিকিৎসা তথা ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয় নি, তাই প্রতিরোই একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা। কীভাবে প্রতিরোধ করবো? ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে। কখন কোন ভ্যাক্সিন কীভাবে দিবেন? একদম সহজ। নিচে কালারবার্ড মুরগীর ভ্যাকসিনের তালিকা ও দিন উল্লেখ করা হলো।
কালারবার্ড মুরগীর ভ্যাকসিনের তালিকা:
রোগের নাম | বয়স (দিন) | মাত্রা | প্রয়োগের স্থান |
---|---|---|---|
রাণিক্ষেত-ব্রঙ্কাইটিস | ৫-৬ | ১ ফোঁটা | চোখে অথবা খাবার পানিতে |
গাম্বুরো | ১১-১২ | ১ ফোঁটা | চোখে অথবা খাবার পানিতে |
গাম্বুরো | ১৭-১৮ | ১ ফোঁটা | চোখে অথবা খাবার পানিতে |
রাণিক্ষেত | ২৩-২৪ | ১ ফোঁটা | চোখে অথবা খাবার পানিতে |
পানিতে মিশিয়ে ভ্যাকসিন খাওনোর ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা:
তবে হাঁ, পানিতে মিশিয়ে ভ্যাকসিন খাওনোর আগে আপনাকে কিছু নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। তাহলে ভ্যাকসিন মুরগীর দেহে ভালোভাবে কাজ করবে। যেমন-
- ভ্যাকসিন মিশ্রিত পানি খাওয়ানোর আগে মুরগীকে সাদা পানি খাওয়াতে হবে।
- ভ্যাকসিন সাধারণত সকালে কিংবা বিকেলে, তুলনামূলক ঠাণ্ডা পরিবেশে (আবহওয়ায়) দিতে হয়।ভ্যাকসিনের পানি এমন পরিমাণে দিতে হবে যেন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে খেয়ে শেষ করতে পারে। কারণ ভ্যাকসিনের পানি বেশিক্ষণ থাকলে এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই ভ্যাকসিন-মিশ্রিত পানি দেয়ার কমপক্ষে দেড় থেকে দুই ঘন্টা আগে খামার থেকে সব পানির পাত্র তুলে নিতে হবে। যাতে করে মুরগীগুলো একটু পিপাসার্ত বা তৃষার্ত হয়। এবং ভ্যাকসিন দেয়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খেয়ে ফেলে।
- ভ্যাকসিনের পানি দেয়ার পর আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যেন সকল মুরগী তা খায়। এজন্য দরকার হলে মুরগীকে ধাওয়া করে খাওয়াবেন। দেখবেন প্রথম সুযোগে মুরগীগুলো বেশ প্রতিযোগিতা তথা কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। প্রথম সুযোগে সব মুরগী খেতে পারবে না। ফলে অনেক মুরগী ভ্যাকসিনের পানি না খেয়েই বসে থাকবে। তখন আপনাকে ধাওয়া করে অর্থাৎ হাত তালি দিয়ে কিংবা মুখে বিশেষ শব্দ করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়াতে হবে।
- ভ্যাকসিনের পানি খাওয়ানোর পর পুনরায় সাদা পানি দিতে হবে
উপর্যুক্ত নিয়ম প্রতিবার ভ্যাকসিন দেয়ার সময় অনুসরণ করতে হবে। এভাবে আমরা ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে রাণিক্ষেত ও গাম্বুরো রোগ প্রতিরোধ করতে পারি ইনশাআল্লাহ।
কালারবার্ড মুরগীর ঠাণ্ডা সমস্যা ও সমাধান:
এবার আমরা আলোচনা করবো কালারবার্ড মুরগীর ঠাণ্ডা সমস্যা নিয়ে। ঠাণ্ডা কোন সময়টাতে বেশি হয় এবং হলে কী করণীয় তা নিয়ে।
মুরগীর কখন ঠাণ্ডা লাগে?
কালারবার্ড মুরগীর একটি প্রধান সমস্যা হলো ঠাণ্ডা লাগা। এটা যে কোনো বয়সে হতে পারে। তবে সাধারণত ১০-১৪ দিন এবং ২০-২৪ দিন বয়সের বাচ্চাদের বেশি হতে দেখা যায়।
ঠাণ্ডা লাগার লক্ষণসমূহ:
- মুরগী বিশেষ শব্দ করবে।
- নাক ঝারবে। অনেক সময় নাক দিয়ে পানি বের হয়।
- হাঁচি, কাঁশি দিবে।
- ঠাণ্ডার প্রকোপ (তীব্রতা) কম হলে বাচ্চা ধরে কানের কাছে নিয়ে গেলে গড়গড় শব্দ শোনা যাবে।
- আর ঠাণ্ডার প্রকোপ (তীব্রতা) বেশি হলে, এমনিতে গড়গড় শব্দ শোনা যাবে।
- খাবার ও পানি কম খাবে।
- মুরগীর ফুরফুরা ভাব চলে যাবে।
- ওজন হ্রাস পাবে।
- পাতলা পায়খানা হয়।
ঠাণ্ডার চিকিৎসা:
ডাক্তারের পরামর্শে ঠাণ্ডার চিকিৎসায় আমরা নিচের ওষুধগুলো খাইয়েছি।
- জিরো সিআরডি: প্রতি ৪ লিটার পানিতে ১ মি.লি.।
- লিভোব্যাক: প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মি.লি.।
- তুঁতে: প্রতি ৫ লিটার পানিতে ১ মি.লি.।
- ডাইজেস্টিভ পি: প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মি.লি.।
প্রথম ৩টি ওষুধ ঠাণ্ডার বিরুদ্ধে কাজ করে। আর নিচের ওষুধটি মুরগীর রুচি বৃদ্ধি করে। এটি খাওয়ানোর ফলে ঠাণ্ডা জনিত কারণে মুরগীর যে অরুচি দেখা দেয়, তা দূর হয়। ফলে মুরগীর খাবারের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং খাবার ও পানি খাওয়া বৃদ্ধি করে।
কালারবার্ড মুরগীর আমাশয় ও রক্ত আমাশয় সমস্যা ও সমাধান:
যত্ন সহকারে কালারবার্ড মুরগী পালন করলে আমাশয় কিংবা রক্ত আমাশয় রোগ হয় না বলেই চলে। কিন্তু অযত্ন ও অসচেতনার কারণে অনেক সময় আমাশয় রোগ সৃষ্টি হয়।
কখন আমাশয় রোগ হয়?
যে কোনো বয়সে আমাশয় রোগ হতে পারে। আমাদের এক ব্যাচে ১৫ দিনের মাথায় আমাশয় রোগ দেখা দিয়েছিলো। সাধারণত, রেনামাইসিন খাওয়ালেই সেরে যায়। আমরাও তাই করেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ সেরে গিয়েছিলো।
রক্ত আমাশয় কখন হয়?
এটিও যে কোনো বয়সের মুরগীর ক্ষেত্রে হতে পারে। আমাদের এক ব্যাচে ১৫ দিন বয়সের বাচ্চার মাঝে এই রোগ দেখা দিয়ছিলো। আবার অন্য এক ব্যাচে দেখা দিয়েছিলো ২৬ দিন বয়সের মুরগীর।
রক্ত আমাশয় রোগের প্রধান লক্ষণ:
এই রোগের প্রধান লক্ষণগুলো হলো,
- মুরগী রক্তের মতো রঙের পায়খানা দিবে। অনেক সময় গাড় খয়েরি রঙের পায়খানা দেয়।
- পালক উসখো-খুসকো দেখায়;
- খাদ্য ও পানি গ্রহণ কমিয়ে দেয়;
- ওজন হ্রাস পায়;
- মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমায়;
- অনেক সময় যেখানে সেখানে ঠোকরা-ঠুকরি করে।
রক্ত আমাশয় রোগের চিকিৎসা:
এই রোগের চিকিৎসায় আমার নিচের ওষুধ দুটি খাইয়েছি।
- ডিকলাসল
- সিপ্রোসল
আল্লাহর রহমতে এতেই এই রোগ দূর হয়েছে।
কালারবার্ড মুরগীর এন্টারাইটিস রোগ; সমস্যা ও সমাধান:
এন্টারাইটিস রোগটিও সচারচর কালারবার্ড মুরগীর মাঝে দেখা যায়। আমাদের খামারে মুরগীর মাঝে অনেকগুলো রোগের সাথে এটাও ধরা পড়ে।
এন্টারাইটিস রোগের লক্ষণ:
- খাবার গ্রহণ ব্যাপক হারে হৃাস পায়;
- মুরগী ফুলে বসে থাকে;
- ওজন হ্রাস পায়;
- পালক এলোমেলো তথা উসকো-খুসকো হয়ে যায়;
- এ রোগে আক্রান্ত হলে মুরগী হঠাৎ মারা যেতে পারে।
এন্টারাইটিস রোগের চিকিৎসা:
রোগে আক্রান্ত মুরগী নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি আমাদের ‘এনট্রিট প্লাস’ নামক এক ওষুধের কথা লিখে দেন। এটি মূলত পাউডার জাতীয়। খুবই মিহি। মুরগীর ফিডের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়। যাই হোক ডাক্তারের দেয়া নির্দেশনা মতে ওষুধ খাওয়াই। আলহামদুলিল্লাহ এতে রোগ মুক্ত হয়। এছাড়াও নিচের ওষুধগুলো ডাক্তার পরামর্শ দেন।
- অ্যামোক্সিসিলিন
- কট্রা-ভেট পাউডার
- ইলেকট্রোমিন পাউডার
বিশেষ সতর্কতা:
- মুরগীর ওষুধ মিশ্রিত পানির পাত্র হোবারের নিচে রাখা যাবে না। এতে করে ওষুধের কার্যকরিতা হ্রাস পেতে পারে।
- খামারে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
- খামারে প্রবেশ করার পূর্বে অবশ্যই জীবাণুনাশক স্প্রে করে প্রবেশ করতে হবে।
- খামারের চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- মাঝে মাঝে খামারে চারিদিকে ভালো জীবাণুনশাক ছিটিয়ে (স্প্রে) দিতে হবে।
- সময় মত লিটার পাল্টাতে হবে।
- লিটার পাল্টানোর সয় একদম নতুন লিটার দেওয়ার পরিবর্তে পুরনো লিটার মিশিয়ে দেওয়া।
- প্রতিদিন লিটার পা দিয়ে ওলট-পালট করে দিতে হবে।
- খামারে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বর্ষারকালে বৃষ্টির সময় যথাসময়ে পর্দা ফেলতে হবে। আবার বৃষ্টি শেষে ওঠিয়ে দিতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
খামারে মুরগী রোগাক্রান্ত হলে অবশ্যই পশু চিকিৎসকের শরণাপ্ন হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ খাওয়াতে হবে। নিজ থেকে কিংবা ওয়েবসাইট থেকে দেখে কখনোই ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
সবশেষ সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
কালারবার্ড মুরগী সম্পর্কে কারো কোনো কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
১-৪৫ দিন কি কি ঔষধ খাওয়াতে হবে
গরমে কি ঔষধ আর শীতে কি ঔষধ
ঠোঁট কাঁটার আগে পরে কি ঔষধ খাওয়াতে হবে